Bangladesh

পণ্য আমদানি থেকে বিক্রি- কিভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট

বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার কয়েকটি বড় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কয়েকজন ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের আমদানিকারক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের জন্য জরুরি নিত্যপণ্যের আমদানি এখন প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি গোষ্ঠী।

তবে বাজারের নিয়ম অনুযায়ী পণ্য আমদানি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার বদলে তারা একে অন্যের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে তাদের কর্তৃত্ব তৈরি করেছে।

এর ফলে বাজারের ওপর একক ‘কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ হয়েছে তাদের, যার জের ধরে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে ভোক্তারা।

আবার ডলারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে বিপদে পড়েছেন ছোট আমদানিকারকদের অনেকে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের এসব আমদানিকারকদের অনেকেই এখন ডলার সঙ্কট আর কথিত সিন্ডিকেট চক্রের সম্মিলিত ‘আগ্রাসনে’ টিকতে না পেরে সরে দাঁড়াচ্ছেন দীর্ঘ দিনের আমদানি বাণিজ্য থেকে।

আবার সরে গিয়েও এসব বিষয়ে তারা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, যদি এ কারণে তাদের অন্য ব্যবসাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘এখানে বড়রা সব একজোট। আমরা ছোটোরা এমনকি এই বড়দের কাছ থেকেও আমরা নিজেদের ইচ্ছে মতো পণ্য নিতে পারি না। বরং তারাই আমাদের ঠিক করে দেয় কোন পণ্য আমরা কার কাছ থেকে কত দরে কিনবো। এভাবেই কয়েকজন মিলে সব করায়ত্ত করেছে।’

ঢাকায় গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমও বলছেন গত কয়েক বছর ধরেই আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি জরুরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখন কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে।

তিনি বলেন, ‘আমদানি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করে নিজেদের শর্তে বাজারে পণ্য দিচ্ছে তারা। তাদের কথা মতো না হলে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে।’

বাজারে প্রতারণা বা ম্যানিপুলেশন বন্ধ করে ভোক্তাদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রতিযোগিতা কমিশন বলছে এ চিত্র তাদেরও জানা।

তবে কারা কিভাবে এসব করছে- এর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি সমীক্ষা করছে এই সংস্থাগুলো।

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘এছাড়া আমরা কয়েকটি স্যুয়োমটো মামলাও করেছি কথিত বড় কয়েকটি গোষ্ঠীর কার্যক্রমের বিষয়ে। এগুলো শুনানি পর্যায়ে আছে।’

প্রসঙ্গত, গত জুনেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রসঙ্গে মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তবে তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে। এজন্য আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।’

বাংলাদেশে অনেক সময় কোনো ভোগ্যপণ্যের দাম অতিমাত্রায় বাড়লে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রে বাজারে সেটিও কার্যকর হয় না।

পণ্য আমদানির জন্য সুপরিচিত কয়েকটি বড় গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আমদানির প্রতিটি ধাপ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট
বাংলাদেশে চিনি, ডাল, তেলসহ সতেরটি পণ্যকে নিত্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব মূল পণ্যগুলো আলাদা করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলোর মার্কেট শেয়ার বড় কয়েকজন আমদানিকারকদের হাতে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে কিভাবে একটি চক্র জরুরি নিত্যপণ্য আমদানি করা থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে তার একটি ‘ভয়াবহ চিত্র’ পাওয়া গেছে।

একজন ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করছে বলেই আমরা ছোটোরা রেস থেকে ছিটকে গেছি। তাদের অবাধ্য হয়ে কোনো ব্যবসাই আমরা এখানে করতে পারবো না। এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায় না।’

এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী যে ধারণা দিয়েছেন তা হলো, বড় ভলিউমে পণ্য আমদানি করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে। এখন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ওই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো থেকে নিজের ইচ্ছে মতো পণ্য কিনতে পারেন না।

উদাহরণ স্বরূপ, একজন উদ্যোক্তা ভাবলেন, তিনি ১০০ কোটি টাকার চিনি বা লবণ কিনবেন। সেজন্য বড় ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারাই ঠিক করে দেন যে কোনো পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে।

এতে রাজী না হয়ে উদ্যোক্তাটি যদি মনে করেন তিনি ব্রাজিল থেকে একশ কোটি টাকার চিনি আনবেন, সে অনুযায়ী তিনি আমদানি করলেও বড় গোষ্ঠীরা তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে চিনি ছেড়ে তাকে লোকসানের মুখে ফেলে দেবে।

আবার বড় চক্রের বাইরে থেকে কেউ আমদানি করতে এলসি খুলতে চাইলেও ব্যাংক রাজী হবে না। এমনকি বাধা আসবে কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দফতর থেকে।

আর ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোনো পণ্য আনলে সেগুলো বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এমনকি শ্রমিক গোষ্ঠীও এসব পণ্য খালাসে কাজ করতে আগ্রহী হয়না।

ফলে অন্যদের আমদানি করা পণ্য কতদিন সাগরে বা জাহাজে পড়ে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আবার খালাস হলেও কাস্টমস ও কর বিভাগ ছাড়পত্র দেবে কিনা- তা নিয়েও সংশয় থাকে।

একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, ‘এভাবে প্রতিটি পদে পদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সিন্ডিকেট। টাকা থাকলেও এদের সাথে কেউ পেরে উঠবে না। এমনকি সরকার একটু দাম নির্ধারণ করে দিলে তারা পণ্য হয়তো জাহাজেই রেখে দেবে কিছুদিন, যাতে সঙ্কটে পড়ে সরকারই চাপ দেয় যে দাম যাই হোক, পণ্য আনুন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কথিত সিন্ডিকেট বলতে যাদের বোঝানো হয় তারা একদিকে যেমন বড় আমদানিকারক, আবার নানাভাবে ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বেও আছেন তারাই।

আবার সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে খালাসের জন্য ব্যবহৃত লাইটার জাহাজগুলোও তাদের কিংবা তাদের সহযোগীদের।

ফলে শ্রমিকরাও মালিকদের বাইরে গিয়ে অন্য কারো জন্য কাজ করতে পারেন না বিপদে পড়ার ভয়ে।

সব কিছুই এই সিন্ডিকেটের হওয়ায় সরকারের রাজস্ব বিভাগের লোকজনও থাকেন চাপের মুখে।

ওই ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘আপনার যত টাকা থাকুক, এদের বাইরে গিয়ে কেউ পণ্য আনার জন্য কোনো ব্যাংকে এলসিই খুলতে পারবেন না। কারণ ব্যাংকও তাদের। হাই কানেক্টেড (উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ) না হলে ব্যাংক কারো এলসি খুলবে না।’

আবার কথিত সিন্ডিকেট কোনো পণ্য এনে যাদের মাধ্যমে বাজারজাত করবে। সেসব প্রতিষ্ঠানও নামে-বেনামে তাদের পরিবারের লোকজনেরই।

এমনকি বড় বড় বাজারগুলোর জন্য এসব পণ্যের ডিলারশিপও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন অনেক ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা যে দামে অন্যদের কাছে পণ্য বিক্রি করেন। তারা মানি রিসিট দিতে চান না, যা রীতিমত অপরাধ।

মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বড়রা ধীরে ধীরে পুরো সাপ্লাই চেনটা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত তারা নিজেদের বলয় তৈরি করেছে। তাদের শর্ত মতোই সব হচ্ছে। তাদের কথা মতো না হলে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। যে কোনো পরিবেশেই হোক ব্যবসা বাণিজ্যে এমন পরিস্থিতি আশঙ্কা জনক।’

তিনি বলছেন বড় গোষ্ঠীগুলো শুধু পণ্য আনাটাই নয়, জাহাজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে।

সরকারের সাথে দাম নিয়ে আলোচনা হলে, বাজেটে শুল্ক হ্রাস বৃদ্ধির বিষয় থাকলে, অথবা সরকার দাম কমানোর বা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে সে সময় হয়তো তারা জাহাজ সাগরেই রেখে দেবেন।

মোয়াজ্জেম বলছিলেন, ‘এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তারা ও ঝুঁকিতে থাকবে বাজার ব্যবস্থাপনা। বাজারের মূল্যবোধ, ভ্যালুজ, সংস্কৃতি সবই নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।’

সমাধানে করণীয় কী ও সরকার কী করছে
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, টেলিকম খাতের মতো নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও ডমিন্যান্ট মার্কেট প্লেয়ারদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত।

তিনি বলেন, ‘তারা কোন পণ্য কি দামে কতটুকু আনছে, কত দামে বিক্রি করছে, কতটা কোথায় মজুদ আছে, – এগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার। এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু করে ব্যাংক লেনদেনের আওতায় এনে প্রতিটি লেনদেনের অনলাইন আপডেট হওয়া উচিত।’

তার মতে, দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতা তৈরি করা না গেলে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা না থাকলে ভোক্তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আবার দেশে যারা উৎপাদন করেন তারাও বিপদে পরবেন।

ঢাকায় প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, তাদের টাস্কফোর্স আছে এবং বাজারের এই অস্থির চিত্র সম্পর্কে তারা অবগত আছেন।

চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘এ নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন দপ্তরকে সাথে নিয়ে আমরা একটি সমীক্ষা করছি। এর ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে আমরা সুপারিশ করবো। পাশাপাশি ৬০-৭০ টি মামলা করেছি আমরা এই কথিত সিন্ডিকেটের লোকজনের বিরুদ্ধে- যেগুলো শুনানি পর্যায়ে আছে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button