Bangladesh

পিএসসির প্রশ্নফাঁস: পুরনো পরীক্ষা বা নিয়োগ কি বাতিল হবে

চাকরি প্রত্যাশীদের আস্থা ও ভরসার জায়গা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। অন্য সবখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও চাকরিপ্রত্যাশীদের আস্থার জায়গা ছিল পিএসসি। কারণ পিএসসির অধীনে অন্তত প্রশ্নফাঁস সম্ভব নয়। তবে সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি সামনে এসেছে। যার সঙ্গে জড়িত পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন ও পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন।

শুধু তাই নয়, গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আরও কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথাও সেখানে দাবি করা হয়েছে। অনেকেই বলছেন, যেসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেগুলোকে বাতিল করা হোক।

পিএসসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রেলওয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সেটি বাতিল করা হবে। তবে পূর্বের পরীক্ষাগুলো নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু সদ্য হওয়া পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও পুরনো পরীক্ষা তথা পুরো নিয়োগ কি বাতিল করা সম্ভব?

এর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশে কয়েকটি বিসিএস-এর পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ২৪তম বিসিএস, ২৭তম বিসিএস। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ৩৩-তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছিল। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাড়াও আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর বিভিন্ন সময়ে আসতে দেখা যায়। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও এসব অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি।

তবে গত ৭ জুলাই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সামনে আসার পরদিন ৮ জুলাই একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করে পিএসসি। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় “গত ১২ বছরে বিপিএসসি’তে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষা সম্পর্কে কোনো মহল থেকে কখনোই কোনো ধরনের অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না বলে এটি প্রমাণিত যে, ওইসব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।”

সেখানে আরও বলা হয়েছে যে প্রশ্নফাঁস রোধ করতে প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় ন্যূনতম ছয় সেট প্রশ্নপত্র এবং নন-ক্যাডার পরীক্ষায় ন্যূনতম চার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। কোন সেটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পূর্বে লটারি করা হয়।”

এ প্রসঙ্গে গত ৯ জুলাই আগারগাঁও কর্ম কমিশন ভবনে প্রশ্নফাঁস নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, প্রশ্নপফাঁস করা ভীষণ কঠিন। কারণ যে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন নির্ধারণ ও সাপ্লাই করা হয়, সেখানে প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। তবে এ কার্যক্রমের সাথে যেহেতু অনেকেই জড়িত থাকেন, তাই শতভাগ নিশ্চিতভাবেও বলা যায় না।

তবে পিএসসি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করলেও এসকল অভিযোগ তদন্ত করার জন্য গত নয়ই জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। ১৫ কার্যদিবসের প্রতিবেদন জমা দেবে তদন্ত কমিটি।

যে ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে পিএসসি’র বক্তব্য জানার জন্য পিএসসি চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি বাংলা। কিন্তু তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পিএসসি, উভয় সংস্থাই এ বিষয়ে তদন্ত করছে, তাই তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নতুন কোনো মন্তব্য করবেন না তিনি।

তবে ৯ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, গত ১২ বছর ধরে যেসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে “কতটা কী হবে,” তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, “যখনই কোনো পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনও অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক, বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পরে প্রমাণ কীভাবে হবে?”

পিএসসির সাবেক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনজীবী, সকলেই বলছেন যে নিয়োগ হওয়ার আগ অবধি পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও নিয়োগ বাতিল করা “অসম্ভব” ব্যাপার।

সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বিবিসিকে বলেন, “নিয়োগ পুরোপুরি বাতিল করলে আরেকটা জটিলতা হবে। ইতোপূর্বে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেগুলো বাতিল করার এখতিয়ার পিএসসির নাই। তবে দোষীকে আইনের আওতায় আনা যাবে। তবে পুরনো সব পরীক্ষা যদি বাতিলও করা হয় তবে তা “হাইকোর্টে টিকবে না।”

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানও প্রায় একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যেগুলো অনেক আগে নিয়োগ হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করার সুযোগ নাই।

‘পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ থেকে দেখা যায় যে, প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে কি না, এ বিষয়ে সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু আইনে “সুনির্দিষ্টভাবে” সেরকম কিছু বলা না থাকলেও “এটি জেনারেল কনসিকুয়েন্সেস। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ও তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তো পরীক্ষা বাতিল হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই,” বিবিসিকে বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও বলেন, আইনে সুর্নির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা না হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করে দিতে পারবে পিএসসি। সেই ক্ষমতা পিএসসি’র আছে। তবে পিএসসিকে সেটি প্রমাণ করতে হবে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করেছিল পিএসসি। আইনে যা-ই থাক, কিন্তু যদি শোনা যায় যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তাহলে প্রশাসনিক দিক থেকেই তো সেই পরীক্ষা বাতিল করা উচিৎ।

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন যে আইনে না থাকলেও “যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তা বাতিল করতে হবে।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button