সংযম, সংলাপের পরামর্শ বারবার দিয়েছিল ভারত : জয়শঙ্কর
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকে সংযম প্রদর্শন এবং সংলাপে বসার পরামর্শ বারবার দিয়েছিল ভারত। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার অব্যাহতি নিয়ে ভারতে যাওয়া এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গতকাল মঙ্গলবার দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ কথা জানান।
এর আগে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এক্স বার্তায় লিখেছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি তিনি বৈঠকে অবহিত করেছেন।
তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি বোঝা এবং সর্বসম্মতিক্রমে সরকারের অবস্থানকে সমর্থনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
বৈঠকে ভারতীয় সব দলের নেতাদের জয়শঙ্কর বলেন, শেখ হাসিনা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই তাঁকে ধাতস্থ হতে সময় দিয়েছে ভারত। আপাতত ভারত হাসিনাকে কিছু দিন সময় দিতে চায়।
তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, তা তিনি ভারত সরকারকে জানাবেন। সেই ভাবনা-চিন্তার জন্য সময় নিচ্ছেন। হাসিনার পরিকল্পনা জানার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে নয়াদিল্লি। এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের রেল যোগাযোগ স্থগিত করেছে ভারত।
এ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ থাকবে। রাজ্যসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কয়েক দশক ধরেই এবং অনেক সরকারের সময়ই ব্যতিক্রমধর্মী নিবিড়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা নিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উদ্বেগ আছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট উত্তেজনা, গভীর বিভাজন এবং ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ হয়েছে। এই অন্তর্নিহিত পটভূমি এ বছরের জুনে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
সংঘাত-সহিংসতা, অবকাঠামোতে হামলার তথ্য তুলে ধরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পুরো সময়ে আমরা বারবার সংযমের পরামর্শ দিয়েছি এবং সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি, যাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল তাদেরও একই ধরনের অনুরোধ করা হয়েছিল।’
জয়শঙ্কর বলেন, গত ২১ জুলাই আদালতের রায় সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। এরপর গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরো উসকে দেয়। এই পর্যায়ে আন্দোলন এক দফায় রূপ নেয়। আর সেটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত ৪ আগস্টের ঘটনাগুলো খুব গুরুতর মোড় নেয়। সহিংসতার সামগ্রিক মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও পুলিশ স্টেশন এবং সরকারি স্থাপনাসহ পুলিশের ওপর হামলা আরো তীব্র হয়েছে। সারা দেশে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে উদ্বেগের বিষয় ছিল, সংখ্যালঘু, তাদের ব্যবসা ও মন্দিরও একাধিক স্থানে হামলার শিকার হয়েছিল। হামলাগুলোর পূর্ণ মাত্রা এখনো স্পষ্ট নয়।
জয়শঙ্কর বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট কারফিউ সত্ত্বেও ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা একত্র হয়েছিল। নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃশ্যত পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খুব সংক্ষিপ্ত নোটিশে তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর ভারতে যাওয়ার বিষয়টি অনুমোদনের অনুরোধ করেছিলেন। আমরা একই সঙ্গে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্সের জন্য একটি অনুরোধ পেয়েছি। তিনি সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছেছেন।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো বিকশিত হচ্ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত সোমবার জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেন। তিনি একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ভারত তার কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভারতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং ক্রমাগত যোগাযোগ রাখছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৯ হাজার ভারতীয়র মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ভারতীয় ছাত্র। হাইকমিশনের পরামর্শে গত জুলাইয়েই বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভারতে ফিরেছে।
জয়শঙ্কর বলেন, ঢাকায় হাইকমিশন ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে ভারতের সহকারী হাইকমিশন রয়েছে। স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওই স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা দেবে বলে আশা করছে ভারত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার অপেক্ষা করছে ভারত।
জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমরা সংখ্যালঘুদের অবস্থার বিষয়েও নজর রাখছি। তাদের সুরক্ষা ও মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন দল ও সংস্থার উদ্যোগের তথ্য রয়েছে। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। তবে স্বাভাবিকভাবেই আইন-শৃঙ্খলা দৃশ্যমানভাবে পুনঃস্থাপন না হওয়া পর্যন্ত ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন থাকবে। এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ব্যতিক্রমী সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও ভারত নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।