Bangladesh

নির্যাতন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন ডিবি হারুন, পুলিশ বাহিনীতে পরিচিত ছিলেন ‘কুলাঙ্গার’ ও ‘বেয়াদব’ হিসেবে

২০১১ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংদ ভবনের সামনে এক মিছিলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে মারধর করে প্রথম আলোচনায় আসা হারুন এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাত খাইয়ে ভিডিও ছেড়ে দেয়া, বিরোধী দলের প্রতিটি আন্দোলনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে ‘বোমা ও বাঁশের লাঠিসোটা› উদ্ধার, প্রতিদিনই সাংবাদিকদের একাধিকবার ব্রিফিং করা, তারকাদের সাথে ফটোসেশন, যাকে তাকে ডিবিতে তুলে নিয়ে আসা, হেফাজতে নির্যাতন, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়-এমন নানান নেতিবাচক কাজে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত এই কর্মকর্তা। অনেকেরই প্রশ্ন পুলিশ বাহিনীতে ‘কুলাঙ্গার’ ও ‘বেয়াদব’ হিসাবে পরিচিত এই ডিবি হারুন এখন কোথায়? একটি সূত্র দাবি করছে, সমালোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা এখন রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে পলাতক আছেন পুলিশের অন্তত ৫৭ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়ন্দা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদও।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০তম বিসিএস ক্যাডারে পুলিশের চাকরি নেয়া হারুন ১৯৯৮ সালে ছাত্রলীগের বাহাদুর-অজয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একসময় চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে চাকরি নেয়ার পর থেকেই ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চোখে ‘বেয়াদব’ হিসেবে পরিচিত হলেও নানা অপকর্ম করে অদৃশ্য কারণে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান।

ডিবি হারুনের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে বাড়ি হওয়ার সুবাদে এক সময় জাতীয় সংসদের স্পিকারের নাম ভাঙিয়ে তিনি নানা অপকর্ম করেও পার পেে ছেন। তেজগাঁও জোনে থাকাকালে জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম ভাঙিয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মোটা অংকের চাঁদাবাজি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় দখলবাজির রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলেও অভিযোগ আছে।

গুলশানে এডিসি থাকাকালে একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ নিয়ে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ গুঁড়াদুধ ভেজাল বলে আটক করেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হওয়ার দাপটে তিনি সব সময়ই পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতেন। একই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপির নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে গেলেও কেউ কিছু বলার সাহস করতো না।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ওই ব্যবসায়ীকে আটক করে ক্রসফায়ারেরও হুমকি দেন তৎকালীন এডিসি হারুন। এ অভিযোগ পাওয়ার পর ওই বিভাগের তৎকালীন ডিসি ঘটনার তদন্তে সত্যতা পেয়ে শাস্তি হিসেবে তাকে এপিবিএনে বদলি করা হয়। সেখানে যোগদান না করে তদবিরের মাধ্যমে তিনি ওই আদেশ বাতিল করে তেজগাঁও জোনে পোস্টিং নেন।

১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে শিশু অপহরণ করে ছাত্রাবাসে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ ছিল। ওই সময় ঘটনাটি পত্রিকায় ছাপা হয়। হারুনের স্ত্রী আমেরিকা প্রবাসী হওয়ার কারণে তিনি অনেক সময় ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন। স্ত্রী আমেরিকার নাগরিক হওয়ার সুবাদে হারুনেরও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব। মাঝে মাঝেই তিনি আমেরিকায় যেতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোটা অংকের টাকা কামিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর চিন্তা ছিল তার। ডিবি হারুনের ঘনিষ্ঠ অনেকেই বলেছেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের পিটিয়ে আলোচনায় এসে ভবিষ্যতে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন এলাকা থেকে এমপি নির্বাচনে অংশ নেয়ারও খায়েশ ছিল তার।

পুলিশ বাহিনীর সবাই জানে হারুন গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্ব পাওয়ার পর নিরপরাধ মানুষকে গোয়েন্দা হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করে এবং ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। হাসিনা পতনের সূতিকাগার কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনের সময় তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নূরনবীকে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে এক পর্যায়ে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকী দিয়েছিলেন।

জানা গেছে, পদোন্নতি পেয়ে ২০২২ সালের ১২ জুন ডিএমপির ডিবি প্রধান হিসেবে যোগদান করেন বহুল সমালোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। এ পদে ছিলেন প্রায় দুই বছর এক মাস। এর মধ্যে অনেক সমালোচনারও জন্ম দেন তিনি। অবশেষে তার ভাত কাণ্ড নিয়ে আদালতের উষ্মা প্রকাশের পর তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় ডিএমপির গুরুত্বপূর্ণ এ পদ থেকে। সংযুক্ত করা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) হিসেবে।

দুই বছর ডিবি প্রধান হিসেবে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা, সেলিব্রেটি নায়িকা ও ছাত্রনেতাদেরকে নিজ অফিসে নিয়ে ভাত খাইয়েছেন হারুন অর রশীদ। আবার সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশও করেছেন। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচিত সমালোচিতও ছিলেন তিনি। অনেকে রসিকতার ছলে ডিবি অফিসের সেই ডাইনিং রুমকে ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ বলে মন্তব্য করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি একটি সুপরিচিত নামও ছিল।

গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হেফাজতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর শেষবারের মতো আলোচনায় আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন। পরে সমন্বয়কদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার ছবি এবং তাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন তিনি।

তার এই কর্মকাণ্ডকে জাতির সাথে মশকরা বলেও মন্তব্য করেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের পরও ওই ছয় সমন্বয়কারীকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয় প্রায় এক সপ্তাহ। এর মাঝে তার একটি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হাসিনার পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে লাপাত্তা এ দাপুটে কর্মকর্তা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button