দেড় যুগ পর স্বস্তির সময়ে বিএনপি: ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
দেড় যুগের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও সঙ্কটের পথ পেরিয়ে স্বস্তির আবহে আজ ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুক্তির উদযাপনে পার হচ্ছে দলটির এখন প্রতিটি দিন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরপরই দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দেশে ফেরার প্রক্রিয়া চলছে। নেতাকর্মীরাও মিথ্যা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কারাগার থেকে বের হয়ে আসছেন। সব মিলিয়ে সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। এমন অবস্থায় আজ ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে বিএনপি। তবে দেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সীমিত করেছে দলটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল, সেটি তারা বন্যার্তদের সহায়তায় ব্যয় করবে।
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির এখন মূল লক্ষ্য- আগামীতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া। এ লক্ষ্যে জনগণের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলটি মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষার নির্বাচন। তাই নেতাকর্মীদের জনগণের আস্থা নষ্ট করে এমন কাজ পরিহার করে মানুষের পাশে থেকে তাদের মন জয়ের জন্য বলা হয়েছে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিবে। সেই অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই ক্ষণে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি সৃষ্টির ৪৬ বছর পরে এসে আজ দলের সামনে নতুন করে উন্মুক্ত হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস, যে ক্যানভাসে অঙ্কিত হবে গণতন্ত্রের নতুন সূর্য। যে স্বাধীনতার ঘোষণা একদিন দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং যে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষাই আজ রচিত হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপ্লব, যেমন সেদিন সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ভেতর দিয়ে বাকশাল দূর করে বাংলাদশে হয়েছিল প্রথমবারের গণতন্ত্রের পুনরুত্থান ।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা ও গণন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮-এর ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আগামীতে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি হবে এমন এক বাংলাদশ যেখানে থাকবে না ক্ষমতার দম্ভ অথবা আস্ফালন, থাকবে না অত্যাচার-নির্যাতন, থাকবে না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। সেখানে থাকবে মেধার মূল্য, যেখানে মানুষ বুক ভরে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে, যেখানে কথা বলার অধিকার থাকবে, থাকবে ভোটের অধিকার, সর্বোপরি থাকবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। যেখানে স্বৈরাচারী সরকারের বুলেটের গুলিতে আর কাউকে প্রাণ দিতে হবে না ।
মঈন খান বলেন, এই মহান আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে যাবে, আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বিএনপি অতীতের ভুল-ভ্রান্তি দূর করে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই মহান দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা।
বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা, সেটি তারা ধরে রাখবেন এবং রাষ্ট্র কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আনবে, যার ভিত্তি হবে ৩১ দফা রূপরেখা। সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ওই রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রকাঠামোয় যে সংস্কার আনবে, সেগুলোকে তারা ধরে রাখবেন এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা, জেল-জুলুম, গুম-খুন তথা নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একইসাথে দলটিকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়েছে। নবম সংসদ নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফল আসেনি বিএনপির। এরপর ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় সংবিধানে তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। পরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো ফল হয়নি। এই নির্বাচনের আগে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করে দলটি। বরং বিএনপি এবং মিত্রদের আন্দোলন ও বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত প্রশ্নবিদ্ধ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় এক দিকে হামলা-মামলা-নির্যাতন এবং অন্য দিকে সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনেও কাক্সিক্ষত ফল না আসায় সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও চরম হতাশা ভর করে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ করে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। কোটাবিরোধী এই আন্দোলন যে একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হবে, শুরুতে সেটি কারোর ভাবনায় ছিল না। ছাত্রদের ওই আন্দোলনে বিএনপি সমর্থন জানায় এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ দলটির অন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাতে অংশগ্রহণও করে।
একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, যেটি ছিল বিএনপির নেতাকর্মীদের বহুদিনের চাওয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি লাভ করেন। ড. ইউনূসের সরকারকে সমর্থন জানিয়ে সার্বিক সহযোগিতার কথা জানায় বিএনপি। একইসাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দলীয় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের জন্য। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। তারেক রহমানের নির্দেশে দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশেও দাঁড়ায়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী : ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমে পাঁচ দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু বন্যার কারণে পরে সেই কর্মসূচি সীমিত করা হয়। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবার বর্ণাঢ্য কর্মসূচির আয়োজন থাকছে না। সীমিতভাবে কর্মসূচি পালিত হবে। পরিবর্তিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ রোববার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এ ছাড়া দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে দেশের মানুষ ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের জন্য দোয়া করা হবে; বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাতে দ্রুত দেশে ফিরে আসতে পারেন, সেজন্য দোয়া করা হবে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনাদের হাতে জিয়াউর রহমান শহীদ হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালে বিএনপির হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। তিনি দলের চেয়ারপারসন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে।
বাণী : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, এখন গণতন্ত্রকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। আইনের শাসন, মত প্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই দেড় যুগব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান সার্থক হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভলগ্নে আমাদের অঙ্গীকার হোক বাংলাদেশকে নিপীড়ন-নির্যাতনসহ সব পৈশাচিকতা মুক্ত একটি সুস্থির-শান্তিময় নাগরিক অধিকার সুরক্ষার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। দেশজুড়ে যেন আর কখনোই গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, টাকা পাচারের মতো ঘৃণ্য বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি না হয়।
তিনি বলেন, জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য।