মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে বিদেশগমন সহজ করতে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ যে ভূমিকা রাখতে পারে
খাত সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসী খাতে গতি আনতে, জালিয়াতি বন্ধে ও খরচ কমাতে এমন একটি ডেটাবেস ও রিক্রুটিং ব্যবস্থার দাবিতে কথা বলে আসছেন।
কাজের সন্ধানে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য রয়েছে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ। এটি দক্ষ ও অদক্ষ উভয় কর্মীদের বিশাল ডেটাবেজের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের নানা জটিল কাজ সহজে সমাধান করার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অ্যাপটির সুসজ্জিত ডেটাবেস ও সংশ্লিষ্ট নানা সেবা অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে।
অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বেশিরভাগ সময়ই ডেটাবেজ ব্যবহারের বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কেননা তারা অভিবাসন ফি যথাসম্ভব বাড়িয়ে বেশি লাভ করতে চায়।
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপটি বেশ উন্নত রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। যার মাধ্যমে প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক লাখ লাখ প্রবাসী কর্মী সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাদের সাথে যুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ, প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সহজেই সরাসরি যোগাযোগ, অনলাইনে ইন্টারভিউ ও চাকরি খুঁজে পেতে পারে।
অ্যাপটি দক্ষ কর্মীদের জন্য একটি অপার সম্ভাবনা। বিশেষ করে যারা কি-না নিয়োগের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে বৈধ চাকরি খুঁজে পেতে চান।
খাত সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসী খাতে গতি আনতে, জালিয়াতি বন্ধে ও খরচ কমাতে এমন একটি ডেটাবেস ও রিক্রুটিং ব্যবস্থার দাবিতে কথা বলে আসছেন।
বর্তমানে বহু বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে কম বেতনের চাকরি পেতে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। মূলত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মধ্যস্বত্বভোগী ও রিক্রুটিং এজেন্সির কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হয় ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ। এরপর থেকেই এটি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সহযোগিতায় এসব সমস্যার নতুনভাবে প্রযুক্তিগত সমাধানের চেষ্টা করে আসছে।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম টিবিএস-কে বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের জন্য একটি ডেটাবেস তৈরির দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এতে খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে।”
শাকিরুল ইসলাম আরও বলেন, “এখন আমাদের ডেটাবেজ আছে। সেক্ষেত্রে এখান থেকেই এখন এজেন্সিগুলো কর্মী নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা উচিত।”
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপটির প্রভাবও বেশ নজরে আসার মতো। মাত্র দুই বছরে এটি ব্যবহার করে প্রায় ২৫ লাখ বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে।
বর্তমানে অ্যাপটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৫ লাখ। দেশের ২৫০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স কার্ডের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে। তবে মাত্র ৫০টি এজেন্সি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার জন্য ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপটি ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান অবশ্য ডেটাবেসটি ব্যবহৃত না হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি টিবিএস-কে বলেন, “অনেকে অ্যাপটি সম্পর্কে জানেনই না। একইসাথে প্রায়শই আমাদের যে নির্দিষ্ট ধরনের কর্মী প্রয়োজন তাদের ডেটাবেজে সেটি সবসময় পাওয়া যায় না।”
শামীম আহমেদ আরও বলেন, “উপরন্তু, নির্দিষ্ট খরচে কর্মী পাঠানোর বিষয়টি বাধ্যতামূলক থাকা উচিত নয়। এর পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেনের সুবিধার মাধ্যমে সিস্টেমটি আরও নমনীয় করা উচিত।”
এদিকে অ্যাপ কর্তৃপক্ষ আগামী মাস থেকে প্রবাসীদের জন্য সরাসরি রিক্রুটমেন্ট কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করেছে। যাতে করে বিদেশি নিয়োগকর্তারা রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ডেটাবেস থেকে কর্মী নিতে পারেন।
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান তারিক ই হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমাদের কাছে তথ্য আছে, কর্মী রয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে নিয়োগের ব্যবস্থা আছে। এটি আগে কখনো ছিল না। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়টি বিদেশি কোম্পানির কাছে স্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে আমরা একটি সিস্টেম তৈরি করেছি যার মাধ্যমে তারা নিরাপদে কর্মী নিয়োগ করতে পারবে। তবে এটিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করতে আমাদের সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।”
তারিক ই হক আরও বলেন, “সরকারের উচিত ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপকে সহযোগিতা করা। যাতে করে বিদেশি নিয়োগকারীরা সরাসরি সাধারণ বা দক্ষ কর্মী নির্বাচন করতে পারে। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরও সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, প্রবাসে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ইংরেজি পরীক্ষায় লেভেল ২ শেষ করে তাদেরকে কীভাবে তাদের লেভেলে ৩ শেষ করানো যায় সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।”
তারিক ই হক বিদেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরির চাহিদাপত্রের জন্য অনলাইন প্রত্যয়ন ব্যবস্থা চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
‘আমি প্রবাসী’ যেভাবে সময় সাশ্রয় করছে
অতীতে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীদের সরকারি কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপ নানা অফিসে দৌড়ঝাঁপ করে ম্যানুয়ালি করতে হতো। এজন্য প্রায়শই চাকরি থেকে ছুটি নিতে হতো। এমনকি চাকরি হওয়ার পরেও এই সরকারি প্রক্রিয়াগুলি সম্পন্ন করতে দালালদের সাহায্য নিতে হতো। এক্ষেত্রে পোর্টালসহ ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ চালুর পর থেকে সরকারি সব সার্ভিসগুলো এখন অনলাইনেই পাওয়া যাচ্ছে।
অ্যাপটির মূল সেবা হচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যাক-এন্ড সফটওয়্যার। যেটি এখন অনলাইনে প্রতিটি ফাইল ও আবেদন অনুমোদনে ব্যবহৃত হয়।
আমি প্রবাসী অ্যাপ ব্যবহার করে প্রি-ডিপারচার ওরিয়েন্টেশন সম্পন্ন করতে এক মাসের মতো সময় লেগে যেতো। তবে এখন মাত্র তিন দিনের মতো সময় লাগে। এছাড়াও বিএমইটি রেজিস্ট্রেশনে আগে চার-পাঁচ দিন সময় লেগে যেতো। কিন্তু এখন তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে করা যায়।
অতীতে চাকরি খোঁজার পর বিদেশে যেতে অন্তত দুই মাসের মতো সময় লেগে যেত। এখন এটি ২০ দিনের মধ্যে করা সম্ভব। ফলে অ্যাপটি বিদেশগমনের কাগজপত্র প্রক্রিয়ার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছে।
অ্যাপটি যেভাবে প্রবাসীদের খরচ কমিয়েছে
অতীতে নিজেই কাগজপত্র গুছিয়ে বিদেশে যেতে চাইলে ঐ ব্যক্তিদের বিএমইটির ইস্যু করা স্মার্ট ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এজন্য তাদের রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে যেতে হতো।
অ্যাপটির কর্তৃপক্ষের দাবি, কার্ডটি পেতে আগে এজেন্সিগুলোকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হতো। ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ চালুর পর এই প্রবণতা বন্ধ হয়েছে।
বর্তমানে একজন কর্মীকে শুধু নিজ থেকে ভিসা যোগাড় করতে হবে। এরপর তাকে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড পেতে কারো ওপরই নির্ভর করতে হবে না।
এখন বিদেশে যেতে ইচ্ছুক বেশিরভাগ কর্মীই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করছে। তারা এর এক বা একাধিক ফিচার চালাচ্ছেন। এমনকি কেউ কোনো ফিচার ব্যবহার না করলেও তাকে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের পক্ষ থেকে কিউআর কোড দেওয়া হচ্ছে। কোডটি বিনামূল্যে পাওয়া যায় বলে এখানে ব্যবহারকারীদের অর্থ বেঁচে যাচ্ছে।
নিজ থেকেই যারা ভিসা ও চাকরি যোগাড় করে ফেলতে পারেন তারা এখন বাকি কাজও নিজ থেকে করে ফেলতে পারছেন। যেমনটা আগে সম্ভব ছিল না। এতে করে তাদের ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।