Hot

অতীত বিবেচনায় ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বার্তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র: প্রতিনিধিদল ঢাকায়

ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ওয়াশিংটনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। প্রতিনিধিদলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু। মার্কিন প্রতিনিধিদলের সব সদস্য শনিবার ঢাকায় পৌঁছান পৃথক ফ্লাইটে। সফরের প্রথমদিনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। আজ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়াও অর্থ উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পররাষ্ট্র সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবেন তারা। আলোচনায় দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অর্থনীতি ও অংশীদারিত্বের বিষয় থাকবে বলে কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। প্রতিনিধিদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডনাল্ড লু বাংলাদেশে আসার আগে ৩ দিন ভারতে ছিলেন। তিনি শনিবার বিকালে বাংলাদেশে পৌঁছান। 

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে ওয়াশিংটন কীভাবে কাজ করতে পারে তা নিয়ে আলোচনাই লু’র এবারের সফরের মুখ্য উদ্দেশ্যে। দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে এরইমধ্যে খবর বেরিয়েছে, গত ৩ দিনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিরিজ আলোচনা হয়েছে সফরকারী মার্কিন প্রতিনিধিদলের। ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক আন্দোলনে ভারতের বর্ডার লাগোয়া বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, সেটি তাদের আলোচনার বাইরে ছিল না। যদিও এ নিয়ে এখনো কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে দিল্লি পাঠিয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু কাজ হয়নি। বিরোধী দলকে বাইরে রেখে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচন নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের অবস্থানে ভিন্নতা ছিল সেটি তাদের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সফরে প্রমাণ হয়। অনেকে এখন বলছেন, সেই সময়ে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে আজ শেখ হাসিনার এই পরিণতি হতো না। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনাসহ নানা কারণে সম্পর্কের টানাপড়েন থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনো এ অঞ্চলে ভারতকে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করে। লু’র দিল্লি সফরে তার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কেন্দ্রস্থলে থাকা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে সেটি ট্রাম্প আমল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দফায় দফায় স্পষ্ট করেছে ওয়াশিংটন। এটা প্রতিষ্ঠিত যে, এক সময় দিল্লির চোখেই বাংলাদেশকে দেখতো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু না, গত ক’বছরে সম্পর্কের চরম টনাপড়েনের মধ্যেও ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ডিল করেছে ওয়াশিংটন। বিশেষ করে ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফরের পর থেকে। পর্যবেক্ষকরা বলছে, নানা কারণে মার্কিন ফরেন পলিসিতে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানই এখানে মুখ্য। বাংলাদেশের পট পরিবর্তনে নানা কথা চাউর রয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন এটা স্পষ্ট করেছে যে, যেটুকু পরিবর্তন এসেছে তা বাংলাদেশের দেশের মানুষই ঘটিয়েছে। পরিবর্তিত বাংলাদেশ তথা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে যে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবে প্রস্তুত, সেটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিফ্রিংয়ে বারবার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অতীতের টানাপড়েন বিবেচনায় নিয়ে অর্থাৎ নিকট অতীতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। যা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ছায়া ফেলেছ। সেটি মনে রেখেই পরিবর্তিত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এই বার্তা দিতেই নতুন সরকারের এক মাসের মাথায় মার্কিন প্রতিনিধিদলের এবারের সফর হচ্ছে।  

সফর নিয়ে মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিজের মূল্যায়ন: এদিকে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের সম্ভাব্য দিক বিশ্লেষণ করেছেন স্বাধীন বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার জন ড্যানিলোভিজ। একযুগ আগে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। একটি নিবন্ধে তিনি বলেন, বাইডেন প্রশাসনের আন্তঃএজেন্সি প্রতিনিধিদল শিগগিরই  বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণের উদ্দেশ্যেই এই সাক্ষাৎ। মার্কিন ট্রেজারির ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের পর থেকে দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে এই প্রথম  আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হতে চলেছে, তথাপি এই বৈঠক পরবর্তী মাসগুলোর জন্য একটা দিশা দেখাতে পারে (অন্তত ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একটি নতুন মার্কিন প্রশাসন দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত)। যদিও বৈঠকের ফোকাস থাকবে সামনের দিকে, তবে উভয়পক্ষই সামপ্রতিক ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। ইতিবাচক দিক হলো, সামপ্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র (বিশেষ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্‌) বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সমর্থনে সোচ্চার ছিল। একই সময়ে, মার্কিন নীতির সমালোচকরা  উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াশিংটন তার বক্তব্যের সমর্থনে আরও কিছু করতে পারতো, বিশেষ করে বাংলাদেশে  ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে এবং পরের মাসগুলোতে। তা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং প্রধান উপদেষ্টা পদে অধ্যাপক ইউনূসের নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে ওয়াশিংটন। 

ঢাকায় একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্তটি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকার ওয়াশিংটনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এর থেকে বোঝা যায় যে,  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   দু-দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকে মনোনিবেশ করতে চাইছে। একটি ইস্যু যা এই সফরে বড় হয়ে উঠবে তা হলো ভারতের নজরে না দেখে বাইডেন  প্রশাসন কি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে  বাংলাদেশের সমস্যার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত?  ওয়াশিংটন পোস্ট এবং বেশকিছু  রিপোর্ট  প্রমাণ করে যে বিষয়টি নিয়ে কিছু সংশয় রয়েছে। আসলে বাংলাদেশ সফরের আগে মার্কিন প্রতিনিধিদলের  ভারতে পা রাখার বিষয়টি এই জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে যে দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে রাখতে হয় সেই পাঠ এখনো শেখেনি যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনপক্ষের তরফে  তাদের বাংলাদেশি প্রতিপক্ষদের আশ্বস্ত করা গুরুত্বপূর্ণ যে তারা অন্য কারও সুরে কথা বলছে না। সামপ্রতিক বছরগুলোতে, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সংলাপের বেশির ভাগই চীন এবং ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। চীনের কথা মাথায় রেখে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।  হাসিনা সরকার এবং তার সমর্থকরা বেইজিংয়ের  কাছাকাছি যাওয়ার কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের  গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি আমেরিকার মনোযোগ সরাতে চেয়েছিলেন।   কখনো কখনো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই  ফাঁদে পা দিয়েছিল বলেও  মত বিশেষজ্ঞদের।  ৫ই আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূমিকাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাব্য সামরিক ভূমিকার দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে, চীনকে ঠেকাতে জুলাই বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা একটি শক্তিশালী বিকল্প হয়ে উঠতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। একটি পারস্পরিক  অংশীদারিত্বের বিকাশে প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের জন্য উভয়পক্ষের কাছে বেশ কয়েকটি সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, গত পনেরো বছরে সংঘটিত অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জবাবদিহিতার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ  অবস্থানে রয়েছে (জুলাই/আগস্টে বিশেষ ফোকাসসহ)। এর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ফৌজদারি বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি আর্থিক অপরাধের জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার প্রচেষ্টা। সহযোগিতার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডাকে সমর্থন (দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সংস্থার মাধ্যমে) অন্তর্ভুক্ত। নিঃসন্দেহে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার  আরও টেকসই সমাধান নিয়ে উভয় দেশ  আলোচনা করবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button