দেশজুড়ে জাল বিছালেও প্রশাসন ছিল নিশ্চুপ
মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ; সংক্ষেপে এমটিএফই। দেশজুড়ে বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) কারবারের ডিজিটাল জাল বিছিয়ে তুলে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ভুঁইফোঁড় এই অনলাইন প্রতিষ্ঠানের চাতুরীর ফাঁদে পড়ে বরিশাল, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুষ্টিয়া, উত্তরাঞ্চলসহ অনেক এলাকার লাখ লাখ মানুষ এখন ফতুর। দেশে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে অনলাইনের সব কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। কেউ কেউ বলছেন, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে যে পরিমাণ অর্থ গায়েব করেছে, এর চেয়ে ১০ গুণ টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লুট করেছে এমটিএফই।
২০২১ সালের পর থেকে এমটিএফই বাংলাদেশে ভার্চুয়ালি কার্যক্রম চালালেও তা কেন প্রশাসনের নজরে এলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের আনাচে-কানাচে সভা-সেমিনার করে কোম্পানিতে যুক্ত হলে কেমন সুবিধা মিলবে– এর জাদুকরি বয়ানও দেওয়া হয়েছিল। এসব সেমিনারে উপস্থিত থাকতেন এমটিএফইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে কীভাবে ‘শিকড় থেকে শিখরে’ ওঠা যায়, সেই গল্প শোনাতেন তারা। নিয়ম না থাকলেও প্রলুব্ধ করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনশর বেশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দেওয়া হয়। অনেকে আবার ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমটিএফইর সভা-সেমিনারের ছবি প্রকাশ করে অন্যদের আকৃষ্ট করতেন। ৭ আগস্ট প্রথমে কারিগরি ত্রুটির কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি। হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে গত বৃহস্পতিবার অনলাইন থেকে একেবারেই হাওয়া হয়ে যায় এমটিএফই।
এরপর নড়েচড়ে বসেন লাখ লাখ গ্রাহক। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেলে তারা পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার ইউনিটের সদস্যরা এরই মধ্যে ছায়াতদন্ত শুরু করেছেন।
এমটিএফই দুবাই ও কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, এমটিএফই দুবাই (সংযুক্ত আরব আমিরাত) ও কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। একজন চায়নিজও এর সঙ্গে রয়েছেন। তবে দুবাইয়ে প্রতিষ্ঠানটির সদরদপ্তর। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে তাদের নেটওয়ার্ক। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইসরায়েল, উজবেকিস্তান, কেনিয়া, তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ওমান, আইভরি কোস্ট, ইরাক, ইয়েমেন ও জিবুতিতে তারা প্রতারণা করে প্রায় সাত কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সরিয়েছে।
যেভাবে কাজ করত এমটিএফই
এমএলএম কোম্পানির আদলে কাজ করত এমটিএফই। লভ্যাংশ বিভিন্ন জনের মধ্যে ভাগ করা হতো। এমটিএফইতে নিজের প্রমো কোড ব্যবহার করে মানুষকে যুক্ত করতে পারলেই এমটিএফই তাকে সিইও হিসেবে দেওয়া হতো পদোন্নতি। একেকজন সিইওর আওতায় লক্ষাধিক মানুষ এমটিএফইতে যুক্ত রয়েছে। প্রত্যেকের আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। মাসুদ আল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি দুবাই থেকে এমটিএফইর এশিয়া অঞ্চলের দেখভাল করেন।
ক্রিপ্টোকারেন্সির ঝুঁকি যে কারণে
ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে না। তাই অনুসরণ করা যায় না লেনদেনের গতিবিধি। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ পাচার, মাদক, কালোবাজারি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অর্থ স্থানান্তরের আশঙ্কা অনেকের। ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যে একটি হলো বিটকয়েন। ২০০৮ সালের শেষ দিকে জাপানের একদল সফটওয়্যার বিজ্ঞানী ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভাবন করে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করেও এটা সরাসরি আদান-প্রদান (পিয়ার-টু-পিয়ার) করা হয়।
বিটকয়েন তৈরি বা কেনার পর তা গ্রাহকের হিসাবে জমা থাকে। পরে তিনি সেগুলো ব্যবহার করে পণ্য কিনতে বা বিক্রি করতে পারেন। বিক্রি করলে বিটকয়েনের বদলে প্রচলিত অর্থে তা গ্রহণ করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিজ্ঞপ্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছে, এর ব্যবহারে আর্থিক ও আইনি ঝুঁকি রয়েছে।
৬৬৮ ওয়েবসাইট চিহ্নিত
শুধু এমটিএফই নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্রিপ্টোকারেন্সি ও জুয়ার আড়ালে অর্থ তুলছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এখন পর্যন্ত এ ধরনের ৬৬৮টি ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে তা ব্লক করেছে। এ ছাড়া ১৪৮টি অ্যাপ, ৪০১টি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ চিহ্নিত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে সিআইডিকে ১৩৬টি গোয়েন্দা প্রতিবেদন দিয়েছে বিএফআইইউ।
ফাঁদে নিঃস্ব উত্তরের লাখ মানুষ
উত্তরাঞ্চল থেকে লিমন বাসার জানান, বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার এমদাদ প্রায় ৫০ লাখ টাকা খুইয়েছেন এমটিএফই চক্করে পড়ে। তিনিসহ তাঁর পরিবারের আট সদস্য অনলাইন ফাঁদেও এই জালিয়াত চক্রের সদস্য হয়েছিলেন। প্রথম দিকে ভালো লাভ পাওয়ায় লোভে পড়ে তিনি পরিবারের সব সদস্যের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেন। এখন সব টাকা হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারটি। একই অবস্থা ব্যাংকার হাসান ইমামের। মাত্র দুই মাসে বিনিয়োগ করা ২ লাখ টাকা তুলে নিয়ে লোভে পড়েন তিনি। এর পর স্ত্রী ও শিশুসন্তানের নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এখন সব হারিয়ে পাগলপ্রায় হাসান।
বগুড়ার শেরপুরের ব্যবসায়ী আকবর আলী ব্যবসার টাকা অনলাইন বিটে বিনিয়োগ করেন। তিনি কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন সেটা সরাসরি না বললেও টাকার অঙ্ক কোটির কম নয়। আকবর প্রায় পাঁচ মাসে এই টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন বাইনান্স ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে। এখানে তিনি ১৩ হাজার টাকায় ১০০ ডলার পেয়েছেন। সেই ডলার পরে এমটিএফইর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেন। আকবর বলেন, ‘আমি লোভে পড়ে আজ সর্বস্বান্ত।’
বগুড়ার স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন কয়েক কোটি টাকা। তাঁর মাধ্যমে এই কার্যক্রমে যুক্ত হন আরও শতাধিক ব্যক্তি। তারা সবাই নিঃস্ব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া ছাড়াও নওগাঁ ও জয়পুরহাটে ১ লাখেরও বেশি মানুষ এই অনলাইন জালিয়াত চক্রের সঙ্গে ব্যবসায় নামে। গত ছয় মাসে এই তিন জেলার প্রতি উপজেলায় নিজস্ব অফিস খুলেছিল তারা।
পুলিশের চাকরি ছেড়ে এমটিএফইর সিইও মাসুম
কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি মিজানুর রহমান নয়ন জানান, এমটিএফইর প্রতারণায় প্রায় শতকোটি টাকা খোয়ান কুষ্টিয়ার কুমারখালীর প্রায় দুই হাজার মানুষ। বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য, রাতারাতি কোটিপতি হওয়ায় আশায় তারা বিনিয়োগ করেছিলেন।
কুমারখালীতে এমটিএফইর মূল হোতা বাটিকামারা মধ্যপাড়ার মো. মিজানুর রহমান। তিনি ফেমাস ফুলকুঁড়ি বিদ্যালয়ের পরিচালক। আর তাঁর প্রধান সহকারী ছিলেন পৌরসভার ঝাউতলা এলাকার মো. মাসুম আলী। তিনি পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। চাকরি করতেন ঢাকা হেড কোয়ার্টার্সের আইটি সেক্টরে। সম্প্রতি তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে এমটিএফইসহ বেশ কিছু অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন সিঙ্গার প্লাজার দোতলায় ভাড়া অফিসে প্রায় দেড় বছর এ ব্যবসা পরিচালনা করেন মাসুম ও মিজান।
হল বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, মাসখানেক আগে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এ পর্যন্ত মাত্র ৩ হাজার ২০০ টাকা তুলেছিলাম।
সিইও মিজানুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, তিনি সৌদি আরবে হজ করতে গেছেন। তাঁর স্ত্রী সুমি খাতুন এসব নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
খুলনায় ১০ কোটি টাকা হারিয়েছেন দেড় হাজার গ্রাহক
খুলনা থেকে মামুন রেজা জানান, এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন খুলনার অন্তত দেড় হাজার গ্রাহক। তারা খুইয়েছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। নগরীর নিউমার্কেট এলাকার আজিজুর রহমান জানান, পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে এই অ্যাপসের কথা শুনে দুই-তিন মাস আগে তিনি প্রায় আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। প্রথম দিকে লাভও হয়েছে। পরে প্রায় ৮-৯ দিন ধরে অ্যাপস থেকে টাকা তোলা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে তিন-চার দিন আগে অ্যাপসে যে ডলার ছিল, তা এখন ‘মাইনাস’ দেখাচ্ছে।
কারা কী বলছেন
সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষক আরিফ মঈনুদ্দিন বলেন, এ ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা হয় মূলত অনলাইনে। অর্থের লেনদেনও হয় অনলাইনের অবৈধ পথে। এসব অনলাইন বা অ্যাপস পরিচালিত হয় বিদেশ থেকে। তাই সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবু বিটিআরসির তদারকি বাড়াতে হবে। এসব প্রতারণা বন্ধ করা তখনই সহজ হবে, যখন মানুষ লোভ সামলাবে, সচেতন হবে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম আশরাফুজ্জামান দোলা সমকালকে বলেন, এ ধরনের ডিজিটাল প্রতারণার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করব।
ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি তারেক আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা তদন্ত করে দেখব।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরফান আলী বলেন, লোভের ফাঁদে পড়ে মানুষ এভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আর্থিক শিক্ষার অভাবে এমন হচ্ছে। এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকলে আর এমন হতো না।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, অনলাইনে প্রতারণা ঠেকানোর মূল হাতিয়ার জনগণের সচেতনতা। কখন কোন সাইট প্রতারণা করবে, তা তো বোঝা যায় না। কেউ অভিযোগ করলে তখন খতিয়ে দেখে সাইট বা লিঙ্কগুলো বন্ধ করা হয়। এই প্রতারকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইনে, অ্যাপসের মাধ্যমে হাজারো উপায়ে জনগণকে ধোঁকা দেয়। দুটি লিংক বন্ধ করলে এরা চারটি লিংক চালু করে।