Trending

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার: হতে পারে অভিশাপ কিংবা ‘মৃত্যু চুম্বন’

চলতি সহস্রাব্দের শুরুর দিকে বিজ্ঞানের শাখায় নোবেল বিজয়ীদের বোঝাতে ‘নোবেল অভিশাপ’ শব্দের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নিজেদের গবেষণার জগতে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি লাভের পর অনেকেই আদা-পানি খেয়ে গবেষণার কাজ করেন না। তারা বিশেষজ্ঞ না হয়েও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন, কিংবা নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের কাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরে নতুন করে আর পরিশ্রমের প্রয়োজন মনে করেন না।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন সবসময় সাফল্যের স্বর্ণদ্বার হয়ে দেখা দেয় না। কারও কারও জন্য এই বিশ্বখ্যাত লোভনীয় সাহিত্য পুরস্কার ‘মৃত্যু চুম্বন’ হয়েও দেখা দিতে পারে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর অনেকেই আর সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান রাখতে পারেননি। অন্যদিকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে পড়ায় তারা বড় রকমের অস্বস্তিতেও পড়েন।

সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পুরস্কার নাকি মৃত্যু চুম্বন? কোনো কোনো লেখকের জন্য সাহিত্য নোবেল পুরস্কার, যার অর্থমূল্য এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার (প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার), আনন্দ বর্ষণ না হয়ে বরং অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এরকম ঘটনার দুঃখজনক উদাহরণ হলেন সুইডিশ লেখক হ্যারি মার্টিনসন। তিনি মনে করতেন, ১৯৭৪ সালে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ফলে লেখক এবং ব্যক্তি হিসেবে তার অস্তিত্ব পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি সুইডিশ একাডেমির সদস্য ছিলেন, যা ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব পালন করে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই, সুইডিশ একাডেমি তাদের সদস্যকে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা বিপুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। সমালোচনার গভীর বাণে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকেন মার্টিনসন। হতাশার গভীরে তলিয়ে যান। চার বছর পরে ‘হারা-কিরি’-এর মাধ্যমে আত্মহনন করে জীবনযন্ত্রণার অবসান ঘটান।

১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিবের দায়িত্ব পালন করেন হোরাস ইংডাল। তিনি ইমেইলে এল পাইসকে জানান, বহু বছর ধরে দেখেছি, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে অল্প সংখ্যকের জন্য এ পুরস্কার দুর্ভাগ্য, এমনকি অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বলা হয় যে লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তারা, অব্যাহতভাবে ভয়ে ভুগতে থাকেন, লিখতে বসলেই অবিরাম নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেন, ‘নোবেলজয়ী লেখকের মতো উপযুক্ত হচ্ছে কি এ লেখা?’ তবে বিষয়টিকে বাস্তবতার চেয়ে বরং অনেকটা গালগল্প বলেই মনে করেন ইংডাল। সাহিত্যজগতের গুরু হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই নোবেল পুরস্কার অর্জনের পর মাঝারি মানের বই লিখেছেন। তবে বেশিরভাগ লেখকই আগের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন বা নতুন রচনাশৈলীকে বেছে নিয়েছেন। উদাহরণ, ডব্লিউ বি ইস্ট, আইভান বুনিন, থমাস ম্যান বা স্যামুয়েল বেখেট।

চলতি সহস্রাব্দের শুরুর দিকে বিজ্ঞানের শাখায় নোবেল বিজয়ীদের বোঝাতে ‘নোবেল অভিশাপ’ শব্দের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নিজেদের গবেষণার জগতে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি লাভের পর অনেকেই আদা-পানি খেয়ে গবেষণার কাজ করেন না। তারা বিশেষজ্ঞ না হয়েও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন, কিংবা নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের কাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরে নতুন করে আর পরিশ্রমের প্রয়োজন মনে করেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পদার্থবিদ রজার পেনরোজ, লুক মন্টাগনিয়ার এবং জোসেফ স্টিগলিটজের মতো কিছু বিজ্ঞানীকে। তারা নোবেল জয় করলেও পরে বিজ্ঞান নিয়ে কষ্টসাধ্য গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে দেন, অথবা এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকেন যেসব বিষয়ে তাদের ভালোভাবে জানা নেই। বার্সিলোনার পম্পেউ ফাব্রা ইউনিভার্সিটির স্পেনিশ এবং তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক জাভিয়ের অ্যাপারিসিও মায়েদেউ বলেন, বিজ্ঞানে বড়সড় পুরস্কার জয় করা মানে হচ্ছে অসুখে আক্রান্ত হওয়া। নোবেল পুরস্কার কারো কোনো ক্ষতি করে না, তবে ক্যামিলো জোসে সেল, নাদিন গর্ডিমার, জে এমজি লে ক্লোজিও বা হার্টা মুলারের মতো কিছু লেখক এই পুরস্কার জেতার পর উল্লেখযোগ্য আর কিছুই লেখেননি। সাহিত্যের দিক থেকে বিচার করলে তারা মরে গেছেন। খুব কম পাঠকই তাদের লেখা এখন পড়েন।

এমন দুর্ভাগ্য সব বিজয়ীকে একইভাবে কাবু করেনি। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন, নিজস্ব জগৎ থাকা প্যাট্রিক মোডিয়ানোর মতো লেখকরা এ পুরস্কার পাওয়ার পর মোটেও প্রভাবিত হননি বা বিগড়ে যাননি। রাজনৈতিক কারণে ওরহান পামুকের মতো যে লেখকরা নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন, তারা প্রভাবিত হয়েছেন। তারা বিত্তবান বক্তা বনে গেছেন এবং সৃজনশীল হওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। তারা নিজেদের মর্যাদা নষ্ট করেছেন, জানান অ্যাপারিসিও মায়েদেউ।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসও নোবেল পুরস্কার জয় করাকে ভয় পেতেন। তার ভয়ের কারণ ছিল ভিন্ন। নোবেল পুরস্কারকে মৃত্যুদণ্ড সমতুল্য বলে মনে করতেন মার্কেস। তিনি দেখেছিলেন, আলবার্ট কামু, জুয়ান রামন জিমেনেজ, পাবলো নেরুদা, লুইগি পিরান্ডেলো এবং আন্দ্রে গিড এই পুরস্কার পাওয়ার সাত বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পরলোকগমন করেছেন। জন স্টেইনবেকও এই হতভাগ্য গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। নিজের মৃত্যুর কিছু আগে নোবেল পুরস্কারকে ‘মৃত্যু চুম্বন’ হিসেবে উল্লেখ করেন সল বেলো। তিনি নিজেও নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে গার্সিয়া মার্কেসও পুরস্কার জয় করেন। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। নোবেল লাভের পরও তার লেখনী থেমে থাকেনি। কয়েকটি সেরা বই, যেমন লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা (১৯৮৫) এবং দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ (১৯৮৯) তার হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

উইলিয়াম ফকনার এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নোবেল পুরস্কারকে বিদায় উপহার হিসেবে ভাবতেন। তারা মনে করতেন, নিজ পেশাদার লেখক জীবনের সমাপ্তির দিকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক কালের অনেক বিজয়ীরা এ পুরস্কারকে পছন্দ করেননি। ১৯৯৬ সালে নোবেল জয়ী পোলিশ কবি উইসলাওয়া সিজিম্বরস্কা বলেছিলেন, এ পুরস্কার তার ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তিনি নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলার মতো মনে করেছেন। ডরিস লেসিং ২০০৭ সালে নোবেল জয় করেন। বাড়িতে যাওয়ার পথে ট্যাক্সি থেকে নেমে সুখবর পাওয়ার পর উত্তেজিত গলায় তিনি বলে উঠেন, ‘ওহ খ্রিষ্ট!’

এলফ্রিড জেলেনেক এবং হার্টা মুলার পুরস্কার পাওয়ার পর মানুষের বাড়তি মনোযোগ পছন্দ করেননি। এত বড় পুরস্কার পাওয়ার পরও তারা খুশি হননি।

২০২২ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন অ্যানি এরনাক্স। তিনি বলেছিলেন যে, এতে মোটেও খুশি হতে পারেননি। নোবেল পুরস্কারের দাপ্তরিক অংশটুকু ‘ভারী’ এবং তার ‘লেখার সব সময়কে কেড়ে নিয়েছে।’ মে মাসে আল পাইসকে এ সব কথা বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘এই পুরস্কার আমাকে গণ-ব্যক্তিত্ব বা পাবলিক ফিগারে পরিণত করেছে। আগে আমি লেখক ছিলাম, এখন আমি হয়েছি আইকন, প্রতীক প্রভৃতি। সে সব বড় বড় শব্দ আমার কাছে কোনও অর্থ বহন করে না।’ তিনি নিজেকে ভার্জিন নটর-ডেম ডি বোলোনের মতো মনে করেছেন, যার কুশপুত্তলিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গোটা ফ্রান্স জুড়ে কুচকাওয়াজ করা হয়েছে।

মানুষের মনোযোগ টানতে চান না যে সব লেখক, বিশেষ করে যদি তারা বয়সি হন, তাদের জন্য এ পুরস্কারের প্রভাব মোকাবিলা করা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে ক্যারিবিয়ান থেকে প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন ডেরেক ওয়ালকট। পুরস্কার অর্জনের পর তিনি বলেন, ‘সে এক ভয়াবহ সময় গেছে। অনেক প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং তার জবাবও দিতে হয়েছে।’ স্বতন্ত্র প্রকাশনা সংস্থা নোরডিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন ডিয়েগো মোরেনা। এ সংস্থায় টমাস ট্রান্সট্রোমার, পিটার হ্যান্ডকে এবং জন ফসের মতো তিন নোবেলজয়ীও ছিলেন। মোরেনা বলেন, ‘আমার মনে হয় না নোবেল পুরস্কার তাদের ওপর কোনও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে।’ এমন লেখকও আছেন যারা জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখতে খুব পছন্দ করেন। আবার অন্যদল লেখক আছেন যারা সংবাদ মাধ্যমে সামনে আসতে চান না।

পেঙ্গুইন র‍্যানডম হাউসের সম্পাদকীয় পরিচালক পিলার রেয়েস বলেছেন, নোবেল পুরস্কার বিশাল সম্মান, তবে এর সঙ্গে দায়িত্ব এবং প্রতিশ্রুতি জড়িয়ে রয়েছে। বিজয়ীকে যখন একটি দেশ বা ভাষার প্রতিনিধিত্ব করতে বাধ্য করা হয়, তখন সমস্যা দেখা দেয়। এ ভূমিকা লেখকের সত্তার বিরোধী হয়ে ওঠে। রেয়েস আরও বলেছেন, লেখককে পুরোপুরি মুক্ত হতে হবে এবং তিনি কোনও বিশেষ কিছু সমর্থক হবেন না। 

২০২২ পর্যন্ত সালমাড্রারা সম্পাদকীয় পরিচালক সিগরিড ক্রাউস বলেছেন, সবকিছুই লেখকের চরিত্র এবং কখন তিনি পুরস্কার পেলেন তার ওপর নির্ভর করে। লেখালেখি থেকে অবসর নিতে চলেছেন এমন লেখকের জন্য এ পুরস্কার খারাপ ফলাফল বয়ে আনতে পারে। প্রথমদিকে তারা হয়ত জীবনের নতুন পর্যায়টি উপভোগ করেন, কিন্তু কিছুদিন পরেই এটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ক্রাউস আরও বলেছেন, নোবেল পুরস্কারকে যারা স্বীকৃতি হিসেবে গ্রহণ করেন, তারা একে উপভোগ করেন। এ ধরনের লেখকরা তাদের বই বারবার প্রকাশিত হতে দেখে উল্লসিত হন। সত্যি বলতে কি, পুরস্কারের সাথে আর্থিক লাভও কম হয় না। সমালোচনা সত্ত্বেও প্রায় কেউই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেননি।

১৯৬৪ সালে জ্যঁ পল সার্ত্রে নোবেল পুরস্কার এবং তার সাথে পাওয়া অর্থ প্রত্যাখ্যান করেন। তার আশঙ্কা ছিল, এ পুরস্কার গ্রহণ করলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তার সৃষ্টির প্রতি বদলে যাবে। পাশাপাশি তিনি প্রশাসনের কেউ হতে চাননি। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র লেখক, যিনি এ পুরস্কার অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button