সরজমিন: ৩ হাসপাতাল ভোগান্তির পুরনো চিত্রই
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর রোগী ভোগান্তি কমলেও এখন আবারো রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রোগী পরিবহনে হাসপাতালের বেড, ট্রলি, হুইল চেয়ার এমনকি এম্বুলেন্স- এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের ম্যানেজ না করে পাওয়া যায় না। ইমার্জেন্সি ও বহির্বিভাগের ওটিতেও বখরা দেয়া লাগে রোগীর স্বজনদের। এসব হাসপাতালের চিকিৎসককে দেখাতে একমাসের সিরিয়ালও টাকার বিনিময়ে মিলে যায় ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে।
গতকাল সকালে সরজমিন রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগের সামনে হুইল চেয়ার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে দশ থেকে পনেরো জন মধ্য বয়সী নারী-পুরুষ। এম্বুলেন্স, সিএনজি কিংবা রিকশায় চেপে যে রোগীই আসছেন, তাদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন তারা। রোগী তাদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইমার্জেন্সিতে। সেখান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আবারো তাকে নিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে। একদম হাসাপাতালের বেডে পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। আবার বেডের রোগীকে ট্রলিতে করে নিয়ে আসছেন বাইরের পার্ক করা গাড়ি পর্যন্ত। কেউ আবার রোগীকে ট্রলিতে উঠিয়ে ঠেলতে ঠেলতে চলন্ত গাড়ি পার করে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালের সামনের মেইন রাস্তা পার করে বেসরকারি ডায়াগনস্টিকে। আর হুইল চেয়ারে বসিয়ে রোগীকে হাসপাতালের বাইরে বা পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিত্র যেন ভাত-মাছ। তবে টাকা ছাড়া রোগী পরিবহনের এসব ট্রলি-হুইল চেয়ারের শিকলে বাঁধা তালা খোলে না কেউ। তাই টাকার বিনিময়েই গতকাল নিজের অসুস্থ মাকে রিকশা থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসাতে বাধ্য হন মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে আগেও এসেছি। এখানে টাকা ছাড়া কিছুই মেলে না। আমার মা অসুস্থ। এখন তাকে যে ইমার্জেন্সিতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, কোনো ট্রলি, হুইল চেয়ার নেই। যেগুলো আছে তা দখল করে রেখেছে কিছু মহিলা। তাদের টাকা না দিলে এগুলো পাওয়া যায় না। আব্দুল ওয়াহাব নামে আরেক রোগীর স্বজন বলেন, এই হাসপাতালে যা খুশি তাই হচ্ছে। কিছু মানুষ যারা হাসপাতালের কেউ না, তারা সকল রোগীকে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের টাকা না দিয়ে কেউ কোনো রোগী হাসপাতালে ঢোকাতেও পারে না, বেরও করতে পারে না। সাইফুল নামে এক রোগী বলেন, শুধু হুইল চেয়ার-ট্রলি নয় এই হাসপাতালের ঘাটে ঘাটে টাকা দেয়া লাগে। তিনি বলেন, বাসার বাথরুমের সামনে পড়ে গিয়ে আমার কপাল কেটে যায়। পরিবারের লোকজন আমাকে এই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসে। গাড়ি থেকে নেমে ইমার্জেন্সি পর্যন্ত যেতে হুইল চেয়ারে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য ২শ’ টাকা দেয়া লাগে খালাকে। এরপর ডাক্তার দেখে ইমার্জেন্সি ওটিতে যেতে বলেন। সেখানে গেলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে আমার ভাবীকে বলা হয়, এসব ওষুধ আনতে হবে। কিন্তু সেসব ওষুধ আনার আগেই আমার ক্ষত স্থানে সেলাই করে ব্যান্ডেজ করা হয়ে যায়। এরপর ওটিতে থাকা লোকজন আমার ভাবীকে বলেন, ওষুধ লাগবে না। আমরা কাজ করে দিয়েছি। এখন আমাদের ২ হাজার টাকা বকশিশ দেন। পরে ১২শ’ টাকায় রফাদফা হয়। ড্রেসিং করাতে আসলেও এখানে বকশিশ দিতে হয়। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আপনাকে বেশকিছু টেস্ট করাতে বলা হবে। এর মধ্যে হাতে গোনা টেস্ট এখানে করানো হবে। আর বড় বড় টেস্টগুলো করাতে ডাক্তার হাসপাতালের সামনের পপুলারে যেতে বলে। সেখানে টেস্ট করাতে গেলেও আবার ডাক্তারের নাম বলতে হয়। এর মানে ওই টেস্ট বাবদ এখানকার ডাক্তার পার্সেন্টেজ পান। গতকাল সকালে হাসপাতালটিতে দায়িত্বরত আনসার সদস্য আ. লতিফ বলেন, এইসব ট্রলি-হুইল চেয়ার হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করে না। যারা এইগুলো দখল করে আছেন তারাই এইগুলো ব্যবহার করে টাকা ইনকাম করছেন।
শেরে বাংলা নগরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পাশেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এই হাসপতালের অভ্যন্তরেও রোগী পরিবহনে রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকের সদস্যরাই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের প্যাথলজি, ক্যাথ ল্যাবসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে টাকার বিনিময়ে আনা-নেয়ার কাজ করে। আর ইমার্জেন্সিতে কয়েকটি ট্রলি রাখা হয়েছে, যা কিনা শুধু গাড়ি থেকে নামিয়ে ইমারজেন্সি পর্যন্ত নেয়া যায়। বাকি কাজ টাকার বিনিময়েই করতে হয়। আর এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের টাকা না দিলে হাসপাতালের বেড পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সজীব নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, হাসপাতালের সামনে থেকে বোঝা যায় না এর ভিতরে কতো দুর্নীতি চলে। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে আমি আমার বাবাকে নিয়ে এই হাসপাতালে রয়েছি। প্রথমদিন রাতে যখন আমি আমার বাবাকে নিয়ে এখানে আসি, তখন ইমার্জেন্সি থেকে সিসিইউতে পাঠানো হয়। সেখানে গেলে বেশকিছু ওষুধ আনতে বলে নার্স। আবার বেডে দেয়ার পর যেই টেস্ট দেয়া হয়েছে তার মধ্যে দুইটা বড় টেস্ট পপুলার থেকে করাতে বলা হয়। হাসপাতাল থেকে নাকি করানো যায় না। পপুলার ডায়াগনস্টিকে টাকা জমা দিলেই তাদের লোক এসে হাসপাতাল থেকে টেস্ট করিয়ে দিয়ে যান। তিনি বলেন, সাধারণত হৃদরোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীরই স্টেন্ট বা ‘রিং’ পরাতে হয়। এনজিওগ্রাম করিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, একবারে রিং পরিয়ে নিতে। এই জন্য পস্তুতি রাখতে বলা হয় রোগীর স্বজনদের। স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারলেও যে রিং স্থাপন করা হয়, সেটির গুণ-মান সম্পর্কে রোগী বা তার স্বজনের জানার কোনো সুযোগ থাকে না। চিকিৎসকরা যেটা ভালো বলেন সেটাই আমরা বিশ্বাস করে নিই। এখানে এক বিশাল সিন্ডিকেট আছে। তাদের এম্বুলেন্স ছাড়া বাইরের কেউ রোগী পরিবহন করতে পারে না। তারা যেই ভাড়া নির্ধারণ করে দেন তা দিয়েই যেতে হয়। গতকাল দুপুরে হৃদরোগ হাসপাতালে এই প্রতিবেদককে সাদা গেঞ্জি পরা এক লোককে দেখিয়ে তিনি বলেন, ওই যে লোকটাকে দেখছেন তিনিই সব এম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণ করেন। মাঝ থেকে তিনি কমিশন খান। কর্তব্যরত আনসার সদস্য জিয়াউলও তাকে দালাল হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
এদিকে একই এলাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতালেরও অবস্থা একই। সেখানেই রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। গতকাল সরজমিন দেখা যায়, ইয়াসমিন নামে এক রোগীর স্বজন তার রোগীকে বহনের জন্য জরুরি বিভাগের সামনে হন্যে হয়ে ট্রলির খোঁজ করছেন। খালি ট্রলি নিয়ে ওয়ার্ডবয়, খালারা যাতায়াত করলেও তাকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাত। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো কাজ না হওয়ায় সহপাঠীকে কোলে নিয়েই ছুটে যান জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে। তিনি বলেন, একেক জন ট্রলি নিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু আমি আমার রোগী নামাবো কেউ দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের রোগী বহনের এইসব ট্রলি যেন তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। একই সময়ে হাসপাতালটি থেকে ছাড় পাওয়া রোগীকে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়ার চিত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ওই দেখেন কীভাবে টাকা নিচ্ছে এই ট্রলি খাটিয়ে। চাঁদপুরের মতলব থেকে গতকাল হাসপাতলটির বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মোতালেব নামে এক রোগী বলেন, এটা সরকারি হাসপাতাল না, এখানে শুধু টাকার খেলা। যেখানে যাবেন সেখানেই টাকা। তিনি বলেন, একটা দুর্ঘটনায় আমার হাতের শিরা কেটে যায়। স্থানীয় সদর হাসপাতাল থেকে হাতে সেলাই দিয়ে বলা হয় বাকি চিকিৎসা পঙ্গুতে। এখানে আসার পর কয়েক দিন ঘুরে একমাস পরের সিরিয়াল পাই। পরে রফিক স্যারের (পঙ্গু’র চিকিৎসক) এটেন্ডেন্টকে ৫শ’ টাকা ঘুষ দিয়ে দশদিন পরের ডেট নিই। তিনি বলেন, ডাক্তার সামান্য দুই দফা চিকিৎসা দিয়েছেন। তাতেই ২৯ হাজার টাকা চলে গেছে। এখনো মূল চিকিৎসা পড়েই আছে। দুইদিন পরে আবার আসতে বলেছে। কিন্তু ঢাকায় থাকার মতো যায়গা নেই তাই বহির্বিভাগের সামনেই মাদুর বিছিয়ে এই দু’দিন স্বামী-স্ত্রী থাকবো।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেছেন, আমরা কখনোই চাই না আমাদের রোগী পরিবহনে বা হাসপাতালে আগত রোগীরা ভোগান্তির শিকার হোক। আমরা এইসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অফিসিয়ালি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরপরও কিছু লোক আমাদের চোখের আড়ালে কিছু কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আমরা এদের বিরুদ্ধে অতিসত্বর যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।