Bangladesh

ভোট চুরি আর দখলের মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনার ভাতিজা নিক্সন

টানা তিনবার ফরিদপুর-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হন মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি ভাঙ্গার আজিমনগরের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে একটি সুবিশাল বাংলোবাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর কথা কেউ অমান্য করলে ধরে এনে শীতের রাতে চুবানো হতো বাংলোবাড়ির সামনের পুকুরে। এ ছাড়া বাড়ির ভেতরে করা হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর ছেলে এবং সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের ছোট ভাই নিক্সন। তাঁর দ্বিতীয় শ্বশুর জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন।

নিক্সন চৌধুরী আগে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কাওড়াকান্দি ঘাটের স্পিডবোট ও ট্রলারের চাঁদা ওঠাতেন তিনি।

শুধু শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের মাত্র ১৯ দিন আগে এসে ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য হয়ে যান। ২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন নিক্সন। এ পদ দিয়েই সরাসরি আওয়ামী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।

সংসদ সদস্য হয়ে ফেসবুকে নিজের নামে একটি পেজ খোলেন। শুরুর দিকে তাঁর ভিডিওগুলো শামীম হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে প্রকাশ করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশের ভিডিও এডিট করে নানা রং লাগিয়ে উপস্থাপন করায় এসব দেখে এলাকার লোকজনসহ প্রবাসীরাও তাঁর ভক্ত হয়ে ওঠে।

কোরবানির ঈদে নিজ বাড়িতে গরু-খাসি জবাই করে নেতাকর্মীদের ভূরিভোজ করাতেন নিক্সন। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে গাড়িতে ঘুরে ঘুরে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করতেন। এগুলো ফেসবুকে ভিডিও ও পোস্ট আকারে প্রচার করতেন।

ফলে দিন দিন বাড়তেই থাকে তাঁর ফেসবুক ফলোয়ার ও জনপ্রিয়তা।

কিন্তু কেউ কি জানত, ভালো ওই মুখের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে? গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বের হতে থাকে নিক্সনের আসল রূপ।

জাফর উল্যাহকে জিরো করে নিক্সন হিরো

২০১৪ সালে নিক্সন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও পুলিশ-প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা কাজী জাফর উল্যাহর। টাকা-পয়সা দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তিন উপজেলার জাফর উল্যাহপন্থী বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও দলীয় নেতাদের নিজের কবজায় আনেন নিক্সন। কোণঠাসা হতে থাকেন কাজী জাফর উল্যাহ ও তাঁর অনুসারীরা। স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দিতেন জাফর। তাঁর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে প্রশাসন ম্যানেজ, ভোট কারচুপি আর সহিংসতার পথ বেছে নিয়ে তাঁদের জিতিয়ে আনতেন নিক্সন। এসব কাজ করার জন্য তাঁর ছিল বিশাল এক মোটরসাইকেল বাহিনী।

প্রশাসন যখন নিক্সনের হাতিয়ার

২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি। কথা না শোনায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দিয়ে গ্রেপ্তার করানো হয় জাফর উল্যাহর অনুসারী ও ভাঙ্গা উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আরাফাতকে। গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফরিদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের তৃতীয় তলার দপ্তরে আনা হয় তাঁকে। ওই রাতে তাঁর ওপর চলা কয়েক দফা নির্যাতনের ভিডিও পরে ভাইরাল হয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, জীবন বাঁচাতে আরাফাত হাতজোড় করে মিনতি জানালে তৎকালীন ওসি (ডিবি) আহাদুজ্জামান আহাদ বলেন, ‘আমি তোদের লোক না। আমি নিক্সন চৌধুরীর লোক।’ এভাবেই ফরিদপুরের পুলিশ-প্রশাসন পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে সাজান নিক্সন।

গালাগাল করতেন প্রতিপক্ষকে

দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যখন যাঁকে প্রতিপক্ষ মনে করেছেন তাঁকেই বাক্যবাণে বিদ্ধ করতেন নিক্সন। কাজী জাফর উল্যাহ, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র কাদের মির্জা (ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই), বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা—কেউই তাঁর গালাগাল থেকে নিস্তার পাননি। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তাঁর প্রার্থীকে বিশেষ সুবিধা না দেওয়ায় মুঠোফোনে এক নারী ইউএনওকে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন। ওই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকারকে রাজাকারসহ অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন নিক্সন। ওই ঘটনায় নির্বাচন কমিশন মামলা করলেও তার অগ্রগতি চোখে পড়েনি।

হাজার বিঘা জমি দখল

স্থানীয়রা জানায়, যে জমি পছন্দ হতো, তা আদায় করে ছাড়তেন নিক্সন। ভাঙ্গার আজিমনগরের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে তিনি যে বাগানবাড়িটি করেছেন সেটিও নামমাত্র টাকায় কেনা। মহাসড়কের কাছাকাছি এসব ফসলি জমি বিঘাপ্রতি তিনি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় কিনে নেন, যার প্রকৃত মূল্য ছিল অন্তত তিন গুণ।

ভাঙ্গার সূর্যনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে নিক্সনের বাগানবাড়ির দূরত্ব দুই থেকে তিন কিলোমিটার। এই পথে যেতে সড়কের দুই পাশে হাজারেরও বেশি বিঘা ফসলি জমি আর কিছু খাসজমিও দখলে নিয়েছেন তিনি। জায়গাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আয়মান আইল্যান্ড’।

এলাকাবাসী জানায়, জমি দখলে নিতে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখাতেন নিক্সন। তাদের বলা হতো, সেখানে হাসপাতাল হবে, পার্ক হবে ইত্যাদি। তারপর মহাসড়কের পাশে, পদ্মা সেতুর কাছাকাছি এই এলাকায় প্লট আকারে জমি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। আশপাশের দু-তিনটি পরিবারের সদস্যরা এই প্রতিবেদককে জানান, আয়মান আইল্যান্ডে তাঁদের জমি তো নিয়েছেনই, বসতবাড়িও চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক পালাবদল না হলে হয়তো বাড়িও ছেড়ে দিতে হতো।

নিজ বাড়ি যখন সাবরেজিস্ট্রি অফিস

স্থানীয়রা জানায়, নিক্সন ও তাঁর ভাই লিখন চৌধুরীর যেসব জমি পছন্দ হতো, সেগুলো দলিল করে দিতে জমির মালিক রাজি না হলে মোটরসাইকেল বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হতো। জোর করে বালু ফেলে ভরাট করা হতো পছন্দের জমি। কাজটি করতেন নিক্সনের ভাই লিখন। এরপর জমির মালিকের কাছে ছবি চেয়ে নিয়ে দলিল তৈরি করে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রারকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন নিক্সন। তাঁর বাড়িতেই নামমাত্র মূল্যে হতো দলিল রেজিস্ট্রি।

এখনো মুখ খুলতে চায় না স্থানীয়রা

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিক্সন পলাতক। তবে তাঁর সীমাহীন অত্যাচারে এখনো শিউরে ওঠে স্থানীয়রা। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস পায় না। তাদের বক্তব্য, নিক্সনের অনেক টাকা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা। তিনি হয়তো সব কিছু ম্যানেজ করে আবার ভাঙ্গায় ফিরে আসবেন। আর ফিরে এলে মুখ খোলার কারণে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button