সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’র পুনঃযাত্রা ষোড়শ সংশোধনী ‘বাতিল আদেশ’ বহাল, দুর্নীতিবাজ বিচারপতির বিচার
সংবিধানের বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী ‘বাতিল আদেশ’ বহাল হয়েছে। গতকাল রোববার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৬ সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সরকারের করা রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ আদেশ দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।্ ইতিপূর্বে ষোড়শ সংশোধনী বিল বাতিল ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। সেই বাতিল আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশনও দায়ের করে। কিন্তু নানা অজুহাতে সেই শুনানি ঝুলিয়ে রাখে আ’লীগ সরকার। এর মধ্য দিয়ে মূলতঃ শেখ হাসিনার সরকার পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ অকার্যকর করে রাখে। সেটি পুনরুদ্ধারে তৎপর হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্যদিকে রিভিউ পিটিশনটি শুনানির উদ্যোগ নেন রিটকারীও। এর ফলশ্রুতিতে বিগত সরকারের করা রিভিউ পিটিশনটির শুনানি হয় গতকাল। রিটের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। সুপ্রিমকোর্ট বারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রূহুল কুদ্দুস কাজল। সরকারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। পিটিশনটির নিষ্পত্তির ফলে পুনরায় উন্মুক্ত হলো দুর্নীতিবাজ, দলকানা ও অদক্ষ বিচারপতিদের বিচারের পথ। এর ফলে উচ্চ আদালতে কর্মরত অসাধু বিচারপতিদের জবাবদিহিতার বিষয়টিও নিশ্চিত হলো বলে মন্তব্য করেছেন মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। তারা আরো জানান, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের ফলে এখন থেকে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এলে সেটি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র দুইজন বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে উক্ত কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে অপসারণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠাবেন। প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এলো।
রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, হাইকোর্টে কিছু বিচারক আছেন যাদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে আদালতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার একটি ফোরাম পেয়েছেন ছাত্র-জনতা।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এরই মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র দু’জন বিচারক মিলে এটি গঠিত হয়। কেউ যদি আজই কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন, তাহলে সেটির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের একটা জায়গায় গেল। একই সঙ্গে দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতি থেকেও বিচার বিভাগ বেরিয়ে এলো। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ঐতিহাসিক একটি দায়িত্ব অর্পিত হলো। তারা যেন তাদের এই শক্তি, মেরুদণ্ড সোজা রেখে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন। যদি তারা (বিচার বিভাগ) এটিকে কাজে না লাগান তাহলে ইতিহাস তার বিচার করবে।
প্রসঙ্গতঃ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান এবং এর কিছু পর্যবেক্ষণ বাতিল করার বিষয়ে সরকারের আবেদন বিবেচনা করতে পারে এমন ৯৪টি কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আপিল বিভাগে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ পিটিশন দাখিল করে। ২০১৬ সালের ৫মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।
রিটকারী ৯ আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। পরে এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে তৎকালীন আ’লীগ সরকার। এ আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিচারকদের অপসারণের বিধান সংবিধানে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তিনি এও জানান, ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহাল, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান এবং এর কিছু পর্যবেক্ষণ বাতিল করার বিষয়ে সরকারের আবেদন বিবেচনা করতে পারে এমন ৯৪টি কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার সরকার আপিল বিভাগে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছিলো।
আদেশের পর মনজিল মোরসেদ বলেন, এ রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রইলো। বিচারপতি পদত্যাগ করলে সেটি এখন থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কউন্সিলের নিয়মের মধ্যে পড়বে।
কী পরিবর্তন এনেছিলো আ’লীগ : ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিচারকদের অপসারণ সম্পর্কিত ৯৬ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে প্রমাণ পেলে এবং সংসদের মোট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলে প্রেসিডেন্টের আদেশে ওই বিচারককে অপাসরণ করা যাবে। অর্থাৎ বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ছিলো জাতীয় সংসদের হাতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীও কার্যত অচল হয়ে যায়। কারণ, ওই সংশোধনীর মাধ্যমে যে ‘বাকশালী শাসন’ চালু করা হয় সেটি বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাও আর প্রেসিডেন্টের হাতে থাকলো না।
এমন শূন্যতার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ২৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’র বিধান করেন। পরে এটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই ছিলো। কিন্তু ওই বছর আওয়ামীলীগ সরকার জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপব্যবহার করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের আদি ‘চার মূলনীতি’ ফিরিয়ে আনাসহ শাসনব্যবস্থার ওপর শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধানে ইচ্ছেমতো কাটা-ছেঁড়া করে। অবশ্য তখনো বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ অক্ষতই ছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালে নবম জাতীয় সংসদে ষোড়শ সংশোধনী এনে শেখ হাসিনা বিচারক অপসারণের প্রক্রিয়াটি জাতীয় সংসদ তথা নিজের এখতিয়ারে নিয়ে নেন।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে ‘২’ যুক্ত করে বলা হয়, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। ‘৯৬’ এর ‘৩’ এ বলা হয়, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।’
এদিকে এমন এক সময় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংবিধানে পুনর্বহাল করা হলো, যখন বিগত দেড় দশকে নিয়োগ পাওয়া অন্ততঃ অর্ধশত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্র্নীতি, দলবাজি এবং শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রকে দীর্ঘায়িতকরণে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অন্ততঃ ৩০ বিচারপতির বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যপকমাত্রায় দুর্নীতি, দলবাজি ও শেখ হাসিনার সমর্থক হিসেবে কাজ করার অভিযোগ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দাবি ওঠে দুর্নীতিবাজ, দলকানা, বিচারপতি পদবিধারী ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’দের অপসারণের। গত ১০ আগস্ট ব্যর্থ জুডিশিয়াল ক্যু’র পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনার নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি। কিন্তু পদত্যাগ প্রশ্নে গো ধরেন বিচারপতির পূর্ণ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধাভোগী হাইকোর্ট বিভাগের বেশ কিছু বিচারপতি। সাধারণ আইনজীবীসহ দেশব্যাপী তাদের পদত্যাগের দাবি উঠলেও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি তারা। এ প্রেক্ষাপটে গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের নেতৃত্বে পুনরায় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সমবেতন হন আইনজীবী-ছাত্র-জনতা। তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ কিংবা অপসারণের দাবি তোলা হয়। এ প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে- এমন অন্ততঃ ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারা এখন ছুটিতে রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আপাতঃ এই ১২ বিচারপতিকে নিয়েই কাজ করবে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’।
ছুটিতে যাওয়া বিচারপতিগণ হলেন, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, খুরশীদ আলম সরকার, মো: আতাউর রহমান খান, খিজির হায়াত, শাহেদ নূর উদ্দিন, এস এম মনিরুজ্জামান, মো: আখতারুজ্জামান, খোন্দকার দিলিরুজ্জামান, মো: আমিনুল ইসলাম, এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, আশীষ রঞ্জন দাস ও শেখ হাসান আরিফ।