Hot

অপারেশন ঈগল হান্ট, নুরীর কান্নার জবাব নেই

২০১৭ সালের ২৬শে এপ্রিল। বুধবার গভীর রাত। শিবনগর গ্রামে হঠাৎ শত শত পুলিশ। প্রত্যন্ত গ্রামে অচেনা সাঁজোয়া যান, জলকামান, প্রজেক্টাইল, কাইনেটিভ আরও কতো কী। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের একাধিক বিশেষ বাহিনী। রাত তখন ১২টা বেজে ২৫ মিনিট। মাত্র ১০ মিনিটে একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। আশপাশের রাস্তাঘাট সিলগালা করা হয়। মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তখনো দুই শিশু সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুর পরিবার কিছু বুঝতে পারেনি। ঘুমিয়ে থাকা পরিবারটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসার মূলফটকে তালা দেয় পুলিশ। চারিদিকে মুর্হুমুহু গুলি। সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ। আতকে ওঠেন গ্রামবাসী। অজানা আতঙ্কে অনেকে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করেন। পুলিশ আবুর ঘরের দরজা, জানালা, দেয়ালে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। বাড়ির ভেতর থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার। ঘরের ভেতর থেকে দারজায় কেউ একজন সজোরে আঘাত করছে। ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। জানালার ধারে হাউমাউ করে কান্না, বাঁচার আকুতি। তবে পুলিশ তখনো ইটের ঘরের চারপাশে শত শত রাউন্ড গুলি ছুড়েছে, বলছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। পুলিশ সেদিন হ্যান্ড ও সাউন্ড গ্রেনেডও  মেরেছে। পুলিশ মাঝেমধ্যে হ্যান্ডমাইকে ঘরের ভেতরে থাকা দম্পতিকে বার বার আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। তখনো গুলি বন্ধ হয়নি। বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয় মুদি দোকানি আবুর বুক। গুলিবিদ্ধ হয় স্ত্রী সন্তানও। কী এমন ঘটেছিল সেদিন? কেনো পুলিশ প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বাড়িতে এমন ভয়ঙ্কর অভিযান চালালো। কেনো একটি পরিবারকে টার্গেট করা হলো। কেনো শিশু-সন্তানসহ একটি পরিবারকে ঘরে অবরুদ্ধ করে শত শত রাউন্ড গুলি করা হলো। কী কারণে আবু নামের ওই মুদি দোকানিকে এত হাঁকডাক করে হত্যা করা হলো? কেনো পুলিশের গুলি থেকে রেহায় পায়নি শিশু সন্তান ও স্ত্রী সুমাইয়া খাতুনও। এসব প্রশ্নের জবাব ৭ বছরেও মেলেনি। এখনো দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কথিত জঙ্গি অভিযানে নিহত আবুর স্ত্রী সন্তান। তবে আর জঙ্গি তকমা নিয়ে বাঁচতে চান না আবুর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন। সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন তিনি। এমনকি ওই অভিযানকে সাজানো নাটক বলেও বিচার চেয়েছেন তিনি। পুলিশের এজহার বলছে,  সেদিন এক আবুকে মারতে ২ হাজার ১২৬ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। ওই অভিযানে অন্তত ১৭টি বিভিন্ন ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশনের ঈগল হান্ট’। এদিকে ওই অভিযানে নিহত আবুর গ্রামের লোকজন এমন দিন আর দেখতে চান না। এই ঘটনার স্মৃতিও কেউ মনে রাখতে চান। তাদের কেউ কেউ বলছেন, আবুর পরিবারের সঙ্গে যে অবিচার হয়েছে। ৭ বছর পরে হলেও এর সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত। দোষীদের বিচার হওয়া উচিত।

পুলিশ বলেছে, সেদিন গোপনে খবর পেয়ে বাড়িটিতে তল্লাশি চালাতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। পরে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ওই বাড়িতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। জঙ্গিরা চার থেকে পাঁচটি বিস্ফোরণ ঘটায়। ধারণা করা হয়, এরা পুরাতন জেএমবি’র সদস্য। নিহত আবুল কালাম আজাদ আবু, তার সহযোগী বাশারুজ্জামান, মিজানুর রহমান ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নিজেদের গ্রেনেডের বিস্ফোরণে মারা গেছেন। জঙ্গি আবুর স্ত্রী ও মেয়ে সন্তানকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর আবুর মৃতদেহ অক্ষত থাকলেও বাকি ৩ জনের বডি বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তবে সেদিনের অভিযান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে এলাকাবাসী। এ ছাড়া মামলার বাদী, এজহারভুক্ত ৯ জন সাক্ষী, লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স চালক ও অভিযান সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যে অনেক গড়মিল পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ এই অভিযানকে সরাসরি সাজানো নাটক বলে দাবি করেছেন।  কেউ কেউ বলেছেন, প্রথমদিনের অভিযান শেষে দ্বিতীয়দিন ভোর রাতে পুলিশ অন্যত্র থেকে ৩টি লাশ এনে অভিযানে নিহত হয়েছেন বলে দেখানো হয়। অনেকে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ আনতেও দেখেছি। তবে কেউ কথা বলার সুযোগ পায়নি। কাউকে সুযোগ দেয়া হয়নি। সেদিন আবু ছাড়া কেউই ওই বাড়িতে নিহত হয়নি। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেদিন রাতে ওই ঘরে আবু তার দুই কন্যা ও স্ত্রী সুমাইয়া  ছাড়া আর কেউ ছিল না। কিন্তু পুলিশ শুরুতে বলেছে ঘরে কয়েকজন জঙ্গি অবস্থান করছে। পুলিশের প্রথম দিনের অভিযানেই আবু গুলিবিদ্ধ হোন। পরে পুলিশ ঘরের ভেতর প্রবেশ করে আবুর পরিবারের সবাইকে অজ্ঞান দেখতে পান। পুলিশ তখন ওই ঘরে আর কাউকে দেখতে পায়নি। উৎসুক জনতাদের কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করেন। তারাও আবু ও তার পরিবারের সদস্য ছাড়া ঘরে তখন আর কাউকে দেখতে পায়নি। এতে অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা এবং জনরোষ এড়াতেই পরে নতুন কৌশল সাজানো হয়। অভিযানের সময় আরেকদিন বর্ধিত করা হয়। ওই ২৭শে এপ্রিল রাতেই গোঁজামিল দেয়া হয়। 

জঙ্গি অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন শিবনগর গ্রামের রেফাউর রহমান। তিনি বলেন, সেদিন এক ভয়ঙ্কর দিন দেখেছি। গভীর রাতে শত শত পুলিশ এসে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। ভয়ে মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। ভোর রাতে প্রচুর গুলির শব্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মুদি দোকানি আবুল কালাম আজাদের বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। জানতে পারলাম ভেতরে জঙ্গি ধরা পড়েছে। অবাক হলাম, সবাই বলাবলি করছে, এখানে জঙ্গি আসলো কোথা থেকে। কিছুক্ষণ পর পর ওই বাড়িটি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে পুলিশ। ভেতর থেকে বাচ্চা শিশু ও মহিলার কান্নার শব্দ আসছে। তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। কিন্তু বাড়ির দরজায় তালা ঝোলানো ছিল। জালানা দিয়ে কেউ একজন উঁকি মারছে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলি ছুড়ছে। এভাবে ১০টা  থেকে বিকাল পর্যন্ত গোলাগুলি চলে। 

স্থানীয় একটি মসজিদের খাদেম আব্দুর রহমান বলেন,  সেদিন পুলিশ কাউকেই বাড়ির আশপাশে ভিড়তে দেয়নি। আমাদের কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়নি। আবু একজন খুবই নিরিহ প্রকৃতির মানুষ ছিল। নিয়মিত মসজিদে আসতো। নামাজ পড়ে চলে যেতো। কিন্তু সে কেনো জঙ্গি হবে? সে কখনো ঠিকমতো শহরেই যায়নি। মসলার ব্যবসা করে সংসার চলে। সে একজন দরিদ্র লোক।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই এলাকার গৃহবধূ সাথী আক্তার বলেন, আমরা বাড়ির ভেতর থেকে কেউ গুলি করছে এবং ভেতর থেকে গুলি আসছে এমন কিছু দেখিনি। আমরা বাহিরেই ছিলাম। বাড়ির মধ্যে থেকে পুলিশকে কেউ গুলি আসলে অবশ্যই আমরা দেখতাম; বরং পুলিশ বাড়ি লক্ষ্য করে শত শত গুলি করেছে। বোমা ছুড়েছে। দরজা জালানা দিয়েও তারা গুলি করেছে। বাড়ি থেকে শুধু কিছুক্ষণ পর পর বাঁচাও বাঁচাও করে কান্নার শব্দ শুনেছি। বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ শুনেছি। 

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী গৃহবধূ মালা খাতুন বলেন, আমি পুলিশকে খাবার রান্না করে দিয়েছি। তারা বাসার কাছে কাউকেই ভিড়তে দেয়নি। সাংবাদিকদেরও আশপাশে আসতে দেয়নি। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এখানে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। পরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে ৩টি লাশ নামানো হয়। লাশের বক্সে ৩টি ওই ঘরে ঢোকানো হয়। তখন প্রচুর লাশ পোড়া দুর্গন্ধ আসছিল। আমি জানতে চাইছি, ‘স্যার এটা কাগো লাশ’। তখন আমাকে ধমক দিয়ে বলেছে বেশি কথা বলবি না। এখান থেকে সরে যা। পরে আমি চলে আসি।

অভিযানে নিহত মিজানুর রহমানের ছোট ভাই সেতাউর রহমান বলেন, আমার বড়ভাই মিজানুর রহমানকে জঙ্গি অভিযানের ৪ মাস আগে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নেয়। শত শত মানুষের সামনে তাকে তুলে নেয়া হয়। এরপরে থানায় গেলে ওসি বলে, আমার থানার পুলিশ আপনার ভাইকে আনিনি। পরে জেলা কারাগারে খোঁজ নেই। সেখানেও আমার ভাইকে পাইনি। ৪ মাস আমার পরিবারের লোকজন সবাই মিলে ভাইকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। পুলিশ তাকে কেনো, কোথায় গুম করে রেখেছে তা আমাদের বলেনি। কিন্তু ২৬শে এপ্রিল ত্রিমোনী জঙ্গি অভিযানে আমার ভাই গুলিতে মারা গেছে বলা হয়। আমার ভাই নাকি জঙ্গি ছিল! তাকে বাড়ি  থেকে তুলে নিয়ে ৪ মাস গুম করে রেখে জঙ্গি বানানো হলো। আবার গুলি করে মারাও হলো। কিন্তু তারপরেও পুলিশ আমার ভাইয়ের লাশ দেয়নি। তাকে কোথায় দাফন করেছে। আজ পর্যন্ত তাও বলেনি। আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি।  
ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আনোয়ার হোসেনের বাড়ি কয়েকটি বাড়ি পরেই। তিনি বলেছেন, বাড়িটির বাসিন্দা আবু এই গ্রামেরই বাসিন্দা ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই চেনেন। তিনি বাজারে মসলার ব্যবসা করতেন। এই বাড়িটিতে আবু তার পরিবার নিয়ে থাকতেন। তবে তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তবে তিনি নিরিহ প্রকৃতির নামাজি লোক ছিলেন। সে জঙ্গি এটা কেউই বিশ্বাস করবে না। এই মধ্যে কোনো ভুল ছিল। সে পুলিশের ভুল সিদ্ধান্তের বলি হয়েছেন, বলছিলেন আনোয়ার।  

বাহিরে থেকে আনা ৩টি লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স চালক আক্তার হোসেন বলেন, ভোর রাতে প্যাকেটভর্তি ৩টি লাশ শিবগঞ্জে আনা হয়। পুলিশ যখন আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে লাশ তোলেন তখন ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। মনে হয়েছে লাশগুলো পচে গেছে। ৪ থেকে ৫ দিন আগের লাশ হবে। না হলে এমন দুর্গন্ধ বের হওয়ার কথা নয়। আমরা ভোররাতে লাশ নামিয়ে দিয়ে চলে যাই। পরে কী হয়েছে জানা নেই। 

আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মোরসেদ আলম বলেন, আমাদের গাড়িতে যেসব লাশ আনা হয়, সেগুলো থেকে পচা গন্ধ বের হয়েছে। উৎকট গন্ধে গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়েছিল। তবে আমরা বৃহস্পতিবার ভোররাতে শিবগঞ্জের একটি গ্রামে নামিয়ে দিয়ে চলে যাই। পুলিশের লোকজন গাড়ির ডালা খুলে লাশ বের করে নেয়। পরে আমরা চলে আসি। পরে কী হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। 

সন্দেহভাজন জঙ্গিদের লাশের মনয়াতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. ইসমাইল হোসেন বলেন, পুলিশ ২৭শে এপ্রিল হাসপাতালে ৪টি লাশ নিয়ে আসে। তখন ৩টি লাশের শরীর পচে গেছে। তাদের  পোস্টমোর্টেম করার মতো অবস্থা ছিল না। মনে হয়েছে কমপক্ষে ৭দিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের পুরো শরীর ছিন্নভিন্ন ছিল। বুকের নিচের অংশ স্প্লিন্টারের আঘাতে পিঁষে গিয়েছিল। তবে একটি লাশ স্বাভাবিক ছিল। গুলিবিদ্ধ ছিল।

এদিকে ওই মামলার আসামি করা হয় ঘটনার ৩ মাস আগে গুমের শিকার হাফিজুর রহমান হাসানকে। তিনি বলেন, আমাকে অপারেশন ঈগল হান্টের কমপক্ষে ৩ মাস আগে পুলিশ বায়তুল মোকাররম থেকে তুলে নেয়। পরে আমাকে চোখ বেঁধে কোথায় নিয়ে যায় তা জানা নেই। তারা আমাকে ৩ মাস গুম রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গি হামলা মামলার আসামি করে আদালতে চালান দেন। আমি অবাক হয়েছে কীভাবে গুম থেকেও জঙ্গি মামলার আসামি হলাম। 

জানা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলার শিবনগর গ্রামে ত্রিমোহনী এলাকায় আমবাগানের ভেতরে একটি অর্ধনির্মিত একতলা বাড়িতে স্থানীয় মুদি দোকানি আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবু, তার স্ত্রী সুমাইয়া বেগম, ৭ বছরের কন্যা শিশু নূর সাদিয়া নুরী, ৫ বছরের আরেক কন্যা সুরাইয়া ইসলাম সাজেদা বসবাস করতেন। ২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল ওই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা আছে বলে সন্দেহ করে পুলিশ। ওই সময় বাড়িতে সন্তানসহ এক দম্পতি অবস্থান করছিলেন। সন্দেহ থেকে বাড়িটি সারাদিন ঘিরে রেখে সন্ধ্যায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। ঢাকা থেকে সোয়াট ও সিটিটিসির বিশেষ ইউনিট নিয়ে অভিযান চালানো হয়। পরে ৪ জন নিহত হোন। 

শিবগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি ও বর্তমান পাবনা চাটমোহর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হাবিবুল ইসলাম বলেন, ওরা (সিটিটিসি) যেটা সাজিয়েছে। মানে আপনি যদি বলেন সাজিয়েছে, তাহলে আমি বলবো এজহারে তারা যেটা লিখেছে আমি ওইটাই দেখেছি। আমার কাগজের বাহিরে কথা বলার সুযোগ নেই। অস্ত্র আবুর বাড়ি নাকি অন্য কোথাও থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, বা কার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে এগুলো আমি ডিটেইল বলতে পারবো না। কারণ ওই মুহূর্তে এসব বিস্তারিত জানার সুযোগ ছিল না। আর তারা যা বলবে আমি তার এন্ট্রি দিয়ে যেতে পারবো? ধরে নেন তারা যা লিখেছে, বলেছে আমি তাদের সঙ্গে একমত। আসলে আমি এটার নামকাওয়াস্তা তদন্তকারী। সব ঢাকা থেকে যারা এসেছে তারাই করেছে। একজন তদন্তকারী অফিসার লাগে তাই আমাকে করা হয়েছে। প্রতিবেদনে যা আছে, সব ঢাকা থেকে লেখা হয়েছে। আমার করা না এসব।

মামলার সাক্ষীরা যা বলছেন: মামলার অন্যতম সাক্ষী সাদেকুর ইসলাম বলেন, আমি সেদিন ওখানে ছিলামই না। তারপরেও পুলিশ আমাকে সাক্ষী করেছে। আমি কিছু না দেখলে কীভাবে সাক্ষী দিবো বলেন? তারপরেও পুলিশ আমাকে ছাড়েনি। তারা আমাকে ধরে নিয়ে সাক্ষী নিয়েছে। আমাকে বলেছে, আমরা যা বলবো তুই শুধু হ্যাঁ বলে যাবি। পরে আমি একটি স্বাক্ষর দিয়ে চলে আসছি। তারা কী লিখেছে, তা আমি কিছু জানি না। পরে মামলার কাগজ তুলে দেখি আমার নামে একটি জবানবন্দি তৈরি করেছে। সেখানে মনের মতো সব লিখে নিয়েছে। অথচ আমি ঘটনার কিছুই জানি না। দেখিও নাই। আমি এর বিচার চাই। 

আরেক সাক্ষী হিটলার বিশ্বাস বলেন, অপারেশন শেষে আমি পুলিশের সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন সেখানে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আবুর স্ত্রী পায়ে জখম হয়ে পড়ে আছে, তার পাশেই শিশু সন্তান অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাদের সন্তানের শরীরের রক্ত দেখেছি। কিন্তু পরদিন সকালে শুনি সেখান থেকে ৪টা লাশ উদ্ধার হয়েছে। শুনে আমি অবাক হয়েছে। বাকি ৩ লাশ আসলো কোথা থেকে?

পুলিশের করা মামলার আরেক সাক্ষী মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার জবানবন্দি দুইবার লেখা হয়। আমি যেটা বলেছি। চার্জশিটে তা বদলে দেয়া হয়। সেখানে আমার বর্ণনার সঙ্গে কোনো মিল নেই। তাদের ইচ্ছামতো লিখে নিয়েছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি এই মামলার সাক্ষী হতে চাইনি। তারা জোর করে সাক্ষী বানিয়েছে। 

মামলার বাদী তৎকালীন শিবগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক আব্দুস সালাম বলেন, অভিযানে কী হয়েছে তা আমার জানা নেই। আর আমি ইচ্ছা করে এই মামলার বাদী হইনি। স্যাররা আমাকে বাদী বানিয়েছে তাই বাদী হয়েছি। আসলে আমরা হলাম হুকুমের গোলাম। তবে এজহারে কী আছে, আর আসলে কী ঘটেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।  

এদিকে পুলিশের জবানবন্দি ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে নিহত আবুর স্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে গুলির আঘাতে আহত বলা হয়। কিন্তু মামলার চার্জশিটে পুলিশ সুমাইয়াকে বোমার স্প্লিন্টারে আহত হয় বলে প্রতিবেদন দেন। সেদিন আবুর শিশু সন্তান নুরশাদও গুলিবিদ্ধ হোন। তবে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে শিশু সন্তানের গুলির বিষয়টি এড়িয়ে যান। 

পরিকল্পনা ঢাকায় অভিযান শিবগঞ্জে: ২০১৭ সালের ২০শে এপ্রিল দুপুর ১২টা। ঢাকার মিন্টোরোডে ডিবি কার্যালয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিল্ডিংয়ের ৪ তলায় একটি জরুরি মিটিং কল করেন ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। এতে সিটিটিসি’র সদস্যদের সঙ্গে তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াটের উপ-কমিশনার ডিসি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার ও তার টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা অংশ নেয়। ওই মিটিংয়ে দেশ জুড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মাত্রা বাড়াতে সবাইকে চাপ দেন মনিরুল ইসলাম। ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে অন্তত ২০টি জঙ্গি অভিযান পরিচালনা করতে নির্দেশ দেন তিনি। যেকোনো মূল্যে এই পরিকল্পনা সফল করতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়। ওই মিটিংয়ে মনিরুল বলেন, জঙ্গি থাকুক বা না থাকুক আমার অভিযান চাই। এটাই সাফ কথা। যারা যত অভিযান করবে তাদের পুরস্কার ও পদন্নতির বিষয়টি দেখা হবে। সামনে নির্বাচন। উপরের নির্দেশ আছে, নির্বাচনের আগে শত শত অভিযান দিতে হবে। অভিযানের স্পট হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলকে টার্গেট করার নির্দেশ দেন মনিরুল। সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি অভিযানের বিষয়ে মত দেন মিটিংয়ে উপস্থিত ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরুল ইসলাম। অভিযানের স্থান নির্ধারণ করেন তিনি নিজেই। পরিকল্পনা সাজানও তিনি। পরে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রয়ল কুমার জোয়ার্দারকে। পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান শেষ করেন প্রলয়। 

যারা অভিযানে অংশ নেয়: আলোচিত ওই অভিযানে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, পুলিশের বিশেষায়িত টিম সোয়াট, পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিট, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। এদিকে অপারেশন ঈগল হান্ট অভিযানের পর ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও গত মাসে ওই অভিযানকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে সে সময় অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ কর্তকর্তাদের বিরুদ্ধে শিবগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন নিহত আবুর স্ত্রী সুমাইয়া বেগম। মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম- বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি, তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব আলম খান- বর্তমানে চট্টগ্রাম ট্রাফিকের ডিসি, শিবগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি হাবিবুল ইসলাম- বর্তমানে পাবনা চানমোহর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, তৎকালীন এসআই আব্দুস সালাম- বর্তমানে নাটোর নলডাঙ্গা থানায় কর্মরত, তৎকালীন জেলা ডিবি’র ওসি মাহবুব আলম, তৎকালীন এসআই আব্দুল্লাহ জাহিদ, শিশির চক্রবর্তী, গাজী মোয়াজ্জেম হোসেন, এএসআই শাহ আলম, এএসআই গোলাম রসুল, সিটিটিসির তৎকালীন প্রধান নুরুল ইসলাম- সাবেক ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ, তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াটের উপ-কমিশনার ডিসি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, তৎকালীন কাউন্টার টেরোরিজমের প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তৌহিদুল আলম, রাজশাহী রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি এম খুরশীদ হোসেনকে আসামি করা হয়।

উল্লেখ্য, ওই বছর মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেড় মাসে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে অন্তত ১০টি বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে নারী ও শিশুসহ অন্তত ১৮ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে এক বছরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে দেশ জুড়ে অর্ধশত ব্যক্তি নিহত হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bandar togel
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor