Trending

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে নির্বাচন ও সংস্কার

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি স্বস্তি না পায়, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নির্বাচন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি– এ দুটিই প্রভাবিত হবে। যদি মনে করা হয়, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথে এগিয়ে যাবে, এমনকি নির্বাচন ব্যবস্থার দিকেও এগিয়ে যাবে আর অর্থনীতির বিষয়গুলো তার মতো চলবে, তাহলে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শেষ বিচারে নির্ধারণ করে দেবে, দেশ কী গতিতে এবং কী পরিধি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে পারবে। সেই সঙ্গে কত দ্রুত বা কত দেরিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার কাছে পৌঁছাতে পারবে। 

গতকাল শনিবার ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ নিয়ে এক সংলাপে এমনটাই মত দিয়েছেন বক্তারা। রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। প্রতিষ্ঠানের চেয়ার মুনিরা খানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, এফবিসিসিআইর সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু, সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন ও সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ ও সাবেক সভাপতি শাহেদুল ইসলাম হেলাল, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এসডিএফ) চেয়ারম্যান ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, অর্থনীতিবিদ ও ঢাবি অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, অর্থনীতিবিদ ও ঢাবি অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ, ঢাবির ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শাহিদুল ইসলাম জাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালেহ আহমেদ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী, ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি সবুর খান, বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক, জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ,  ইউএনডিপি বাংলাদেশের সাবেক সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ চাকমা, সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশিজ-এর চেয়ারপারসন এম এস সেকিল চৌধুরী, ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদিক মাহবুব ইসলাম, শিক্ষার্থী সুপ্রভা সুবহা জামান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমলারা কীভাবে রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ কীভাবে ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ী কীভাবে রাজনীতিবিদ হয়ে গেল এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো না কেন? এ দুষ্টচক্র নিয়ে কেউ কথা বলেনি। বিগত ১৫ বছরে সবকিছু কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেল, তা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। জাতীয় আয়, মূল্যস্ফীতি, খানা জরিপ, রপ্তানি আয় এগুলোর সঠিক তথ্য কেন সামনে এলো না? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসহায় করে ফেলা হলো, আইনপ্রণেতারা কীভাবে স্বার্থভোগী হয়ে উঠল, তা নিয়ে কথা বলা হলো না। প্রাতিষ্ঠানিক, নির্বাচনী সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির বিষয়ে সংস্কারেও মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিমুহূর্তে জবাবদিহি না থাকলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। 

মুনিরা খান বলেন, দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। দেশের অর্থনীতির দুর্বলতা নিয়ে কথা বলতে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে। গণমাধ্যম যখন দেশের ব্যাংকগুলোকে দুর্বল বলে তালিকাবদ্ধ করে, তখন সেখান থেকে টাকা সরিয়ে ফেলার প্রবণতা উল্টো বেড়ে যায়, টাকা পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। এতে ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। আমরা যৌক্তিক সমালোচনা করব, দেশের অর্থনীতি অথবা সরকারকে বিপদে ফেলে নয়। 

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আমাদের যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন তার বেশির ভাগ অংশই আসে আমদানির মাধ্যমে। বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মূল্যস্ফীতি কমাবে এমন আশা করা অনুচিত। সকল সামাজিক সংস্থাকে একত্র করা উচিত। জনগণের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। আগের সরকারের বাজেট এখনও চলছে কেন– এই প্রশ্ন করছেন না কেন? বাজেট কেন নবায়ন করা হলো না? অধ্যাপক ড. ইউনূসকে ব্যবহার করে ঋণ নিতে পারছি, কিন্তু শিল্প নিয়ে আসতে পারছি না। 

পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, আগামী দুই বছরে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে এরকম আশা ছেড়ে দিতে হবে। ৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। পোশাকশিল্পে অস্থিরতা বন্ধে শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। 

ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্র ও মধ্যম ধরনের উদ্যোগে বিনিয়োগ প্রয়োজন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ট্রেড লাইসেন্সসহ সহজ নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তথ্যপ্রবাহ বাড়ানো প্রয়োজন। শাহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে আমরা বের হতে পারিনি। ইচ্ছাকৃতভাবে যারা ঋণী, তাদের বিরুদ্ধে কাজ করা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা উচিত। 

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সরকারি চাকরিতে মাত্র ৫ শতাংশ তরুণ আসছে। বাকি যত কর্মক্ষম তরুণ আছে, তাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভেদ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি ঠিক না হলে কোনো সংস্কারেই কাজ হবে না। গণতান্ত্রিক সরকার এলে অর্থনীতিসহ অন্য সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। 
সুদের চাপে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে জানিয়ে মীর নাসির হোসেন বলেন, নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে লাভ কোন ব্যবসায়ী পাবে? বর্ধিত দাম দিয়েও বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বলি ৬-৯ সুদের হার যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু সকল খাতের সহনীয় ক্ষমতা এক না। এখন এত চাপ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না।
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে কেউ স্বস্তিতে নেই। যেখানে আছি, সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি একটা কারণ। উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। গ্যাসের সরবরাহ নাই, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ সুদহার। এই অনিশ্চয়তা থাকলে কেউ ব্যবসায় আসবে না।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, এর আগে সংস্কারের সুযোগ এলেও ফলপ্রসূ কিছু হয়নি। রাজস্ব আদায়ে স্বচ্ছতা না থাকলে দ্রব্যমূল্য বা ব্যবসার খরচ না কমে বরং বাড়বে। 
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, কোন কোন সমস্যার প্রথমেই সমাধান করা উচিত তার একটি তালিকা প্রয়োজন। আলাদা শিল্পের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রয়োজন। নীতিমালা প্রণয়নে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলেই কোনো নীতিমালাই ফলপ্রসূ হয়নি।

সালেহ আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতদিন ঠিক না হবে, ততদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ঠিক হবে না। এ মুহূর্তে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেওয়া, যা এই দেশের মেরুদণ্ড। 
আলোচনার শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, সংস্কার শব্দটি আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত একটি শব্দ, একসময় যা ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক খাতের লুটপাটের কথা আমরা সবাই জানি। দেশের টাকা চুরি করে দেশের বাইরে চলে গেছে, যা সংকটকে আরও গুরুতর করেছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের সরকার হিসেবে এ সরকারকে কাজ করতে হবে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button