Bangladesh

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন ২০ হাজারের বেশি

  • কোটার অপব্যবহার খুঁজতেই এই তালিকা প্রণয়ন হচ্ছে
  • প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের কোনো সমস্যা হবে না
  • ভুয়া চিহ্নিত হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করবে মন্ত্রণালয়

সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এ পর্যন্ত চাকরি পেয়েছেন ২০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এ তথ্য জানিয়েছেন। ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুঁজে বের করতে এ তালিকা করছে সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি পাঠায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের ৬২টি সংস্থার সচিব/সিনিয়র সচিবদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠি পাঠানো হয়েছে পিএসসিকেও।

চিঠিতে মন্ত্রণালয়গুলোকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ করা জনবলের তথ্য পাঠাতে একটি ছক করে দেওয়া হয়েছে। ছক অনুযায়ী প্রার্থীর নাম, নিয়োগপ্রাপ্ত পদ ও শ্রেণি; বাবার নাম ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ/গেজেটের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন (পিতা, মাতা, পিতামহ, মাতামহ) তার নাম ও ঠিকানা; মুক্তিযোদ্ধার নাম, পিতা/মাতা/পিতামহ/মাতামহের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নম্বর এবং নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার তারিখ জানাতে হবে বলে জানানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে জানান, দু-তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়া অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে তালিকা চাওয়া গেছে। চূড়ান্ত তালিকা না হলেও যে তালিকা এসেছে, তাতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দপ্তর ও বিভাগগুলোয় ২০ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। 

তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে সবচেয়ে বিতর্কিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। ভুয়া সনদে চাকরি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছিল বিস্তর। এই দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রস্তুত করছে। এই তালিকায় কারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা প্রজন্ম আবার কারা ভুয়া, এটি খতিয়ে দেখবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। যদিও এখন পর্যন্ত জামুকা পুনর্গঠন করা হয়নি। শিগগিরই জামুকা কমিটি হবে। জামুকার রিপোর্ট অনুযায়ী সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ জনপ্রশাসনে পাঠানো হবে।

তিনি আরও বলেন, জামুকা না থাকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তা স্থানীয় পর্যায়ে তদন্ত করতে জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে থাকা বিভিন্ন তালিকার সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা হবে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম দায়িত্ব গ্রহণের পরই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় গ্রেড অনুযায়ী কতজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন সেই তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছে। ওই সনদ দিয়ে তারা চাকরি নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ না করে যারা সনদ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

তিনি বলেন, এত দিন কারা মুক্তিযোদ্ধা, সেটা জামুকা নির্ধারণ করে দিত। মন্ত্রণালয় শুধু তাদের নির্ধারিত হওয়া বিষয়টি বাস্তবায়নে যেত। এটার আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা রিভিউ হবে কি না, জানতে চাইলে সাংবাদিকদের উপদেষ্টা জানিয়ে ছিলেন, ‘অবশ্যই হবে, যেন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সম্মানটা ফিরে পান। মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের জাতীয় জীবনে অনন্য ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধা, তারা ওটাই ফিরে পেতে চান। এটাই তাদের ফিরে পাওয়ার আকুতি।’ 

কোটা প্রয়োগ পদ্ধতি : পিএসসির তথ্যানুযায়ী প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই আসে কোটার হিসাব। এই তিনস্তরে উত্তীর্ণ না হলে কেউ কোটা সুবিধার আওতায় পড়েন না। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার নম্বর যোগ করা হয়। এরপর আসে মৌখিক পরীক্ষার বিষয়। এই তিনস্তরে উত্তীর্ণ হলে তখন আসে কোটার হিসাব। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আগে কোটাব্যবস্থা: ভৌগোলিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনতে বিশ্বব্যাপী কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই কোটা ব্যবস্থা বেশি আলোচনায় আসে। সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রসঙ্গ। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে কোটা চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মাত্র ২০ শতাংশ নেওয়া হয়েছিল মেধায় (সাধারণ), ৪০ শতাংশ জেলা কোটা এবং ১০ শতাংশ ছিল নারী কোটা। আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে কোটা সংরক্ষণ করা ছিল ৩০ শতাংশ।

২০১৮ সালে প্রচলিত কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। 

আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, দীর্ঘদিন চলে আসা কোটাব্যবস্থায় অবৈধ সুযোগ নিয়ে চাকরি পাচ্ছেন অনেকে। সরকারি চাকরির সীমিত অবস্থায় রাজনৈতিক এবং ভুয়া কোটাধারীরা চাকরি পাচ্ছেন। বিগত ১৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপব্যবহার করে অনেকেই চাকরি পেয়েছেন এমন অভিযোগে আন্দোলন প্রকট হয়ে ওঠে। পরে উচ্চ আদালত সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করে। কিন্তু এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও কোটা ফিরিয়ে আনা হয়।

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি), নারী ১০, জেলা কোটা ১০ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের বিধান ছিল। এর বাইরে বাকি ৪৫ শতাংশ সাধারণদের জন্য বরাদ্দ। আন্দোলনকারীরা ওই সময় কোটা সংস্কারের দাবি জানান।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ চার সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের: ২০১৪ সালে আলোচনায় আসে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিবকে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী নিজেই মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়েছেন। অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা এক বছর বাড়াতে অবৈধ প্রক্রিয়ায় সনদ নেন তিনি। শুধু তিনিই নন ওই বছর আরও চার শীর্ষ কর্মকর্তা ভুয়া সনদ নেন। 

তারা হলেন- তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার।

যদিও বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে সরকার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অনুমোদন না নিয়ে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের একক ক্ষমতাবলে গেজেট ও সাময়িক সনদ নিয়েছিলেন চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব। তবে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ থাকলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ভুয়া সনদ নেওয়ার প্রমাণ পেলেই সরাসরি দুর্নীতি মামলা করা উচিত। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণ হলেই প্রতারণার মামলায় অভিযোগ গঠন করা যায়। কারণ জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত হয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ফৌজদারি অপরাধ। অতীতে এমন ঘটনায় বিচার হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচার হয়নি তার মানে বিচার হবে না এমন হওয়া উচিত না। বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button