সমকামিতা প্রসারের আশঙ্কা, ঢাকায় মানবাধিকার অফিস খুলতে চায় জাতিসংঘ
বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের কান্ট্রি অফিস খোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ। এ নিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে জেনেভা। সঙ্গে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনে সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তার বিশাল প্যাকেজ অফার করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তামিল বিদ্রোহের ছুতোয় শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকারের কান্ট্রি অফিস খোলার প্রস্তাব ছিল জাতিসংঘের। এ নিয়ে ১০ বছর দেন-দরবার হয়েছে। কিন্তু কলম্বো কোনো চাপেই নতি স্বীকার করেনি। শ্রীলঙ্কায় ব্যর্থ চেষ্টার পর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে অফিস খোলার প্রস্তাব যায়। ট্র্যাক ওয়ান এবং ট্র্যাক টু- উভয় পন্থায় চলে দূতিয়ালি। কিন্তু না, কোনো দেশই অফিস খোলার স্থান দিতে রাজি হয়নি। তাই এবার টার্গেট বাংলাদেশ। আজ থেকে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের ঢাকা সফর। হাই প্রোফাইল ওই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হতে যাচ্ছে ওএইচসিএইচআর’র ঢাকা অফিস খোলার বিষয়টি। ঢাকা ও জেনেভার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো মানবজমিনকে জানিয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এখন বাংলাদেশের পথে। ফ্লাইট বিলম্ব বা অন্য কোনো জটিলতা না হলে ভোর হওয়ার আগেই তিনি ঢাকা পৌঁছাচ্ছেন। বাংলাদেশের মাটিতে প্রায় ৫০ ঘণ্টা কাটাবেন তিনি। ওই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সব উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, সেনাবাহিনী প্রধান এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন স্তরে সিরিজ বৈঠক হবে তার। ভলকার তুর্ক গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য গঠিত ১০ কমিশন প্রধান এবং গুম কমিশনের সব সদস্যের সঙ্গে বসবেন একটি প্রাতঃরাশ বৈঠকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গেও মতবিনিময়ের পরিকল্পনা রয়েছে তার। জেনেভাস্থ অফিস অব দ্য ইউএন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) এর আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার তুর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন।
যেখানে তিনি সামপ্রতিক ছাত্র-আন্দোলনে সম্পৃক্ত প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ঢাকায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন। সফরের সমাপনীতে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিবেন। সংবাদ সম্মেলনটি উন্মুক্ত নয় বরং প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন মিডিয়ার প্রতিনিধিরাই তাতে ঢুকতে পারবেন।
মানবাধিকার অফিসের কাজ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ: ১৯৯৩ সালে জেনেভায় অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৭টি দেশে ওএইচসিএইচআর কান্ট্রি অফিস খুলতে পেরেছে। ব্যাংককসহ কিছু জায়গায় লিমিটেড স্কেলে তাদের রিজিওনাল অফিস রয়েছে। কান্ট্রি অফিস রয়েছে এমন দেশ হলো- বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, গুয়েতেমালা, গায়েনা, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেঙিকো, নাইজার, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন। সেগুনবাগিচার পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে কোনো না কোনো সংকটে রয়েছে এমন দেশেই ওএইচসিএইচআর কান্ট্রি অফিস খুলতে পেরেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গত মাসে ঢাকায় মানবাধিকার অফিস খোলার প্রস্তাব আসে। অবিশ্বাস্য দ্রততায় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া পাঠায় জেনেভা। প্রস্তাবে বলা হয়, সবকিছু ঠিক থাকলে অক্টোবরে ভলকার তুর্কের সফরে খসড়া চুক্তিটি সই হতে পারে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস চালু হলে সেটি মানবাধিকার সমুন্নত ও বিকাশের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক যে সব সনদ অনুসমর্থন করেছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে প্রস্তাবিত দপ্তর পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেবে। আন্তঃসীমান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সুরাহার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবিত অফিসটি বলপূর্বক গুম বিষয়ক কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে কারিগরিসহ নানা রকম সহায়তা দেবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্ত করার ওপর জোর দেবে। নীতি প্রণয়নে সহায়তার জন্য ওএইচসিএইচআর-এর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট গবেষণা পরিচালিত হতে পারে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকায় প্রস্তাবিত ওএইচসিএইচআর অফিস পুলিশ এবং আইন সংস্কারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কারিগরি সহায়তাসহ সামগ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অফিস খোলার চুক্তির খসড়ায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের অবাধে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কোনো গ্রেপ্তার, আটক এবং জেরা করার প্রক্রিয়ায় ওএইচসিএইচআর প্রতিনিধিদের অবাধে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।
প্রস্তাবে সায় নয় যে কারণে: সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ওএইচসিএইচআর-এর প্রস্তাবটি আত্মঘাতী। এটি গ্রহণ করলে এবং তাদের অফিস খোলার চুক্তি সই করলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের বড় ধরনের বিপদে পড়তে হবে। প্রথমত: এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ওএইচসিএইচআর-এর অফিস খোলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর থেকে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী সক্রিয়। ওএইচসিএইচআর-এর প্রস্তাব এসেছে ৫ই আগস্টের এক মাসের মাথায় এবং তা পারসু হচ্ছে নানাদিক থেকে। বাংলাদেশে জাতিগত কোনো সংঘাত হয়নি যে, এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খুলতে হবে- এমন মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, সংঘাতপ্রবণ দেশগুলোতে ওএইচসিএইচআর-এর অফিস রয়েছে। তাছাড়া ওই অফিসের বিরুদ্ধে দুনিয়ার দেশে দেশে সমকামিতার মতো সংবেদনশীল বিষয় প্রমোট করার অভিযোগ রয়েছে। সমকামিতা সব ধর্মে নিষিদ্ধ। অফিস খুলে এটি প্রমোশনের সুযোগ দিলে সরকার বাংলাদেশের সর্ব ধর্মের ধর্মভীরু মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ফলে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির এমন আশঙ্কাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা সমীচীন বলে মনে করছে সেগুনবাগিচা। বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর সব সময় দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয়। দাতা সংস্থাগুলো ওএইচসিএইচআরকে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়নে প্রভাব সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে একটি দেশের কোনো নীতি যখন দাতা দেশগুলোর বিপক্ষে যায়, তখন তারা মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ওএইচসিএইচআর এর মাধ্যমে। জাতিসংঘে কাজ করছেন এমন একাধিক কূটনীতিক জানান, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস কখনো কখনো এমন এজেন্ডার বিকাশে কাজ করে থাকে যেগুলো সর্বজনীন নয়। যেমন তারা সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমন্বিত যৌন শিক্ষার বিকাশে কাজ করে যা অনেক দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার পরিপন্থি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, কিছু স্পর্শকাতর পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস কাজ করে। অথচ চুক্তি করা বা অফিস স্থাপনের অনুমতি দেয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো দেশই ব্যবস্থা নিতে পারে না। এটি করলে উভয় সংকট তৈরি হয়।