Bangladesh

সোহরাওয়ার্দীর গাছ কেটে তৈরি করা ভবনগুলো এখন আড্ডার জায়গা

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে গাছ কেটে তৈরি করা রেস্তোরাঁগুলো এখন ছিন্নমূল মানুষের আড্ডার জায়গা। গতকাল তোলা।

ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার এক বছরেও চালু হয়নি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাতটি রেস্তোরাঁ। তালা মেরে রাখা ভবনগুলোর বারান্দা ও চত্বরে ছিন্নমূলসহ নানাজনের আড্ডার জায়গা। কেউ কেউ সেখানে নানা পণ্যের বেচাবিক্রি করছে। কেউবা সেখানে রাত কাটাচ্ছে।

ভবনগুলো এখন আড্ডার জায়গা

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেস্তোরাঁর জন্য নির্মিত এই সাতটি ভবন বেহাল পড়ে থাকা নিয়ে এখন অনেকেরই কৌতূহল। এ ব্যাপারে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট গণপূর্ত অধিদপ্তর দায় চাপায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওপর। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

এই উদ্যানের আধুনিকায়নে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে ওই সাতটি ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ভবনের জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উদ্যানের গাছ কাটা শুরু হলে এর প্রতিবাদে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও পরিবেশবাদীদের আন্দোলন শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২১ সালের জুনে গাছ কাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তবে গত বছরের জুনে ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

‘এখন মানুষ বসে আড্ডা দেয়, আমরা থাকি’

রেস্তোরাঁ ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলার পাশে ছবির হাটের গেটসংলগ্ন, উদ্যানের ভিআইপি গেটসংলগ্ন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের গেটসংলগ্ন, উদ্যানের লেকসংলগ্ন, রমনা কালীমন্দিরসংলগ্ন, উদ্যানের মুক্তমঞ্চ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি গেটসংলগ্ন স্থানে।

গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে ছবির হাটের গেটসংলগ্ন রেস্তোরাঁ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, সামনের চওড়া বারান্দার বেঞ্চে কিছু মানুষ শুয়ে আছে। আবার কিছু মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে। সেখানে বয়স্ক দিলদার হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে উদ্যানে পানি বিক্রি করছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এইটা থাকার জন্য অনেক ভালো জায়গা। রোদ-বৃষ্টি কোনোটাতেই এইখানে আমাগো সমস্যা হয় না। মাঝেমইধ্যে পুলিশ টহলে আসে। তয় আমাগো থাকতে কেউ বাধা দেয় না। বইমেলা আর কোনো বড় অনুষ্ঠান হইলে শুধু থাকা যায় না।’

ভবনগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছর এইগুলার কাজ শেষ হইছে। এর পর থাইকা তালা মারাই দেখতাছি। আর কেউ কখনো এইগুলা খুলেও নাই, কোনো কাজও করে নাই। এখন মানুষ বসে আড্ডা দেয় আর আমরা থাকি।’

দিলদার হোসেনের কথামতো অন্যান্য রেস্তোরাঁ ভবনেও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও মানুষজন বসে কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে আবার লুডু আর তাসে  মশগুল। দুপুর ১২টার দিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় উদ্যানে বিচরণ করা অনেকে এসে ভবনগুলোর বারান্দায় আশ্রয় নেন।

ভবনগুলোর চিত্র

প্রতিটি রেস্তোরাঁ ভবন বৃত্তাকার এবং সাদা ও লাল রং করা। প্রতিটি ভবনের সামনে অর্ধ বৃত্তাকার খোলা জায়গা, যা অনেকটা বড় বারান্দার মতো। সেখানে গ্রাহকদের বসে খাওয়ার জন্য শানবাঁধানো বেঞ্চ ও টেবিল রয়েছে। উদ্যানে বিচরণ করা লোকজন এই বেঞ্চে আড্ডা জমায়। বৃষ্টির সময়ও অনেকে এসে বসে। হকাররা এখানে চা-সিগারেট, পানি ও ফুল বিক্রি করে।

প্রতিটি ভবনের ভেতরের অংশ লাল রং করা কলাপসিবল গেট দিয়ে আটকানো। প্রতিটি গেটে দুটি করে তালা। একটি ওপরে, আরেকটি নিচে। ওপরের তালা সিল করা। গেটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখা গেল এখনো অনেক কাজ বাকি। চুলার জায়গা দেখা গেল না। পানির কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি। উল্টো ভেতরে জমে আছে ময়লা-আবর্জনা। শুধু ভেতরেই দুরবস্থা নয়, বাইরের দেয়ালগুলোতেও ছাতলা পড়তে শুরু করেছে। রমনা কালীমন্দির ও উদ্যানের মুক্তমঞ্চসংলগ্ন ভবন দুটি দেখলে মনে হয় যেন বহু বছরের পুরনো।

উদ্যানের ভিআইপি গেটসংলগ্ন রেস্তোরাঁ ভবনে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ-ছয় বছর ধরে উদ্যানে ঘুরতে আসি। ২০২১ সাল থেকে এখানে গাছ কাটা শুরু হয়। আমরা আন্দোলন করলে রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে ফেলে। গত বছর দেখলাম সব কাজ শেষ করল। তাও এখন পর্যন্ত এগুলো চালু করল না কেন, এ নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন।’

রেস্তোরাঁর কাজ বন্ধের জন্য হয়েছিল আন্দোলন

প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যানের বেশ কিছু কাছ কেটে ফেলা হলে আন্দোলনে নামে গ্রিন প্ল্যানেট, ষোলো আনা বাঙালি, ছাত্র ফেডারেশনসহ বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন। এ সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। কখনো সমাবেশ, কখনো উদ্যানের ভেতর গাছ লাগিয়ে, কখনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় তারা। তবে এই প্রতিবাদের মুখেও রেস্তোরাঁ ভবনগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

এই প্রতিবাদের মুখে নির্মাণকাজ শেষ করেও এই সাতটি রেস্তোরাঁ চালু হচ্ছে না কেন, এ ব্যাপারে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প। আমাদের কাজ ছিল বাস্তবায়ন করা। আমরা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। এখন কবে তারা রেস্তোরাঁগুলো চালু করবে, এটা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই বলতে পারবে।’

প্রকল্পের ব্যয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি কাগজ দেখে বলতে হবে। আজকে (গতকাল) সরকারি ছুটির দিন। অফিস চলাকালে এলে জানাতে পারব।’

রেস্তোরাঁগুলোর বিষয়ে কথা বলার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালক হাবিবুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার মেসেজ পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button