বছরে গ্যাস অপচয় বছরে গ্যাস অপচয় ১২ হাজার কোটির দায় নিয়ে ঠেলাঠেলি
- গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লস গড়ে ১০-১২ শতাংশ
- সিস্টেম লসের বড় অংশই আসলে চুরি
- গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ২ শতাংশ
দেশে প্রতি বছর গ্যাসের যে বিপুল পরিমাণ অপচয় হচ্ছে, তা ‘সিস্টেম লস’ বা কারিগরি ক্ষতি হিসেবে দেখানো হলেও এর বেশিরভাগই বিতরণ কোম্পানিগুলোর অবৈধ সংযোগের কারণে চুরি হওয়া গ্যাস বলে অভিযোগ রয়েছে। তিন দশকের মধ্যে এই প্রথম পেট্রোবাংলা তথাকথিত সিস্টেম লসের একটা অংশ চাপিয়ে দিয়েছে গ্যাস সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ওপর।
কিন্তু জিটিসিএল এ চুরির দায় নিতে নারাজ। আবার বিতরণ কোম্পানিগুলোও পুরো দায় নিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলছে ঠেলাঠেলি। সিস্টেম লস মূলত এক ধরনের ক্ষতি, যা পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের সময় লিকেজ, চুরি, অবৈধ সংযোগ, কারিগরি লোকসান ইত্যাদি কারণে হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিক্রি না করায় খুবই সামান্য পরিমাণে কারিগরি ক্ষতি ছাড়া বড় ধরনের সিস্টেম লসের সুযোগ নেই জিটিসিএলের। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরি হচ্ছে, তা সমন্বয় করতেই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অনুমোদন ছাড়াই অযৌক্তিকভাবে এ লোকসান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানির ওপর।
প্রায় একই বক্তব্য জিটিসিএলের কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) দাবি, মিটারিং পদ্ধতি চালুর পর গ্যাসের সঠিক পরিমাপ করতে গিয়ে জিটিসিএলের ওপর এ লোকসানের দায় পড়েছে।
গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত এবং আমদানি করা গ্যাস সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির কাছে সরবরাহ করে জিটিসিএল। এরপর বিতরণ লাইনের মাধ্যমে তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় বিতরণ কোম্পানিগুলো। অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ গ্যাস চুরির দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে এসব কোম্পানির ঠিকাদার, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বিরুদ্ধে।
যদিও বিতরণ কোম্পানিগুলোর বক্তব্য হচ্ছে, তারা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি জরিমানা ও আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু কিছুদিনের মাথায় আবার নতুন অবৈধ সংযোগের সন্ধান মিলছে।
সূত্রমতে, কারিগরি ক্ষতির নামে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়েছে। তবে কাগজে-কলমের হিসাবের চেয়ে গ্যাসের প্রকৃত অপচয় আরও বেশি। তাছাড়া বাসাবাড়িতে মিটারবিহীন গ্রাহকরা কম গ্যাস নিয়ে বাড়তি বিল দিচ্ছেন, যার ফলে অপচয় কমিয়ে দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মান অনুসারে বিতরণ লাইনে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ গ্যাস অপচয় হতে পারে। যদিও বাংলাদেশে এই সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ২ শতাংশ স্বাভাবিক ধরা হয়। বাস্তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস হচ্ছে ৭ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে উচ্চ চাপের কারণে সঞ্চালন লাইন থেকে গ্যাস অপচয়ের কোনো সুযোগ নেই।
সর্বশেষ ২০২২ সালে জিটিসিএলের সঞ্চালন চার্জ নির্ধারণের সময় প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম লস শূন্য বিবেচনায় নিয়েছে বিইআরসি। তবে গত বছর জানুয়ারি থেকে জিটিসিএলের ওপর প্রায় ৩ শতাংশ সিস্টেম লস চাপিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার বক্তব্য, সঞ্চালন পয়েন্টে মিটারের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিতে সরবরাহ করা গ্যাসের পরিমাণের মধ্যে যে পার্থক্য হচ্ছে, তার কারিগরি ও আর্থিক ক্ষতি জিটিসিএল বহন করবে।
তবে জিটিসিএল এই লস নিতে অপারগতা প্রকাশ করে তা প্রত্যাহার করতে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে পেট্রোবাংলাকে। কিন্তু তাতে পেট্রোবাংলা তাতে রাজি না হওয়ায় জিটিসিএলের আর্থিক ক্ষতি বেড়ে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিটিসিএলের ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে চাপিয়ে দেওয়া সিস্টেম লসের কারণে। বাকি লোকসান হয়েছে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে।
প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে নিজেরা মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করছে, যার দাম নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে। কারিগরি ক্ষতির অংশবিশেষ জিটিসিএলের ওপর চাপিয়ে দিলে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি, গ্যাসের অপব্যবহার ও কারিগরি ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন জিটিসিএলের কর্মকর্তারা।
জিটিসিএল থেকে গ্যাস নেওয়ার পর বিতরণ লাইনে ঘাটতি পাওয়া গেলে তা সব বিতরণ কোম্পানির মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার নিয়ম চলে আসছিল প্রায় ২৯ বছর ধরে। এ নিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর আপত্তি ছিল। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস সরবরাহের প্রতিটি পয়েন্টে মিটার বসানোর প্রস্তাব ওঠে। এ নিয়ে গঠিত কমিটির পর্যবেক্ষণে সঞ্চালন লাইনে প্রায় ৩ শতাংশ সিস্টেম লস হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
জিটিসিএলের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গত বছর জানুয়ারি মাসে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর কারিগরি যুক্তি, তথ্য আমলে না নিয়ে বিইআরসি ও জ্বালানি বিভাগকে পাশ কাটিয়ে মাসিক সমন্বয় সভায় জিটিসিএলের ওপর অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে লোকসান চাপিয়ে দেন জনেন্দ্র নাথ সরকার।
তবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির মধ্যে মিটারিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস পরিমাপ করে সরবরাহ করতে বিইআরসির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে এখানে। পেট্রোবাংলা কিংবা কারও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।
এদিকে হঠাৎ করে লোকসানের পরিমাণ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় জিটিসিএলের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের দানা বাঁধতে থাকে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পেট্রোবাংলার ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন জিটিসিএলের কর্মকর্তারা। একপর্যায়ে গত ১৯ আগস্ট পেট্রোবাংলার এক আদেশে বলা হয়, জিটিসিএলের সিস্টেম লসের বিষয়টি মন্ত্রণালয়/উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে স্থগিত করা হলো। তবে গত ২২ অক্টোবর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, সিস্টেম লস প্রত্যাহার করা হয়নি। এ দায় জিটিসিএলকেই নিতে হবে।
জিটিসিএল সূত্রমতে, বর্তমানে ৬৬টি মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সঞ্চালন করা হয়। যার মধ্যে জিটিসিএলের নিজস্ব মিটার রয়েছে ২১টি। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনের মাঝখান থেকে ট্যাপিং করে নেওয়া গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের ২০টি, বাখরাবাদের ৮টি, জালালাবাদের ১০টি, কর্ণফুলীর ২টি এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ৫টি মিটার রয়েছে। এসব মিটারের মধ্যে আবার প্রায় ১০টি মিটার রয়েছে বিতরণ কোম্পানির গ্রাহকের আঙিনায়।
জিটিসিএলের অভিযোগ, তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এই ৪৫টি মিটারের মাধ্যমে প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশ গ্যাস বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সঞ্চালনের লাইনের মাধ্যমে দেওয়া গ্যাসের হিসাব ওই মিটারগুলোর সঙ্গে মিলছে না। কারণ এ মিটারগুলো বিতরণ কোম্পানির এবং সেগুলোতে রিডিং নেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণও তারাই করে থাকে। ফলে তারা সঠিকভাবে রিডিং নিচ্ছে কি না বা মিটারে কারসাজি করছে কি না, তা ধরার উপায় নেই জিটিসিএলের।
জিটিসিএল বলছে, বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিকে সরবরাহ করার জন্য মিটার বসিয়েছে জিটিসিএল। কুমিল্লার ইপিজেড, লালমাই ও বিজরা পয়েন্টে গ্যাস নিত বাখরাবাদ। এখন এই তিন এলাকার জন্য দুই বছর আগে মিটার বসিয়ে বিজরা পয়েন্টে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ২০২১ সালে তিন পয়েন্ট মিলে তারা দিনে সাড়ে ৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেত বলে হিসাব দিত বাখরাবাদ। মিটার বসানোর পর গত বছর ৭ জানুয়ারি থেকে তারা দিনে গ্যাস পাচ্ছে সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, জিটিসিএলের এ দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। কারণ ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ মিটার তাদের নিয়ন্ত্রণে। পর্যায়ক্রমে জিটিসিএল তাদের সব মিটার বসানোর পর তখন পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু যতক্ষণ তারা মিটার স্থাপন না করবে ততক্ষণ বিতরণ কোম্পানির মিটারকেই বিবেচনা করতে হবে। তারা যদি বলে তিতাসের মিটারের রিডিং তারা মানবে না, তাহলে একই কথা তো তিতাসও বলতে পারে যে, তারাও জিটিসিএলের মিটার রিডিং মানবে না। তখন কী হবে?
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এক বছর ধরে তদন্ত করে বাস্তবে যে প্রমাণ পাওয়া গেছে সেটিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটা ঠিক, তিতাস ও অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির কিছু সমস্যা আছে। সেজন্য অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করেছেন তারা। কিন্তু জিটিসিএলের লোকসানের দায় কেন তিতাস বা অন্যরা নেবে? যার যার দায় সে নেবে।
জনেন্দ্র নাথ বলেন, জিটিসিএল লোকসান করায় তাদের সঞ্চালন চার্জ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছর তাদের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান হলেও এ বছর সেটি কমে ১৭০ কোটি হবে। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল পুরোপুরি সচল থাকলে এ লোকসান কাটিয়ে ব্রেক ইভেনে চলে যেত জিটিসিএল। মূলত তাদের মিটারিং সিস্টেমে ত্রুটির কারণেই এ লোকসান হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সুফী দেশ রূপান্তরকে বলেন, গ্যাস সঞ্চালন লাইনে কারিগরি লোকসান ছাড়া অন্য কোনো ধরনের লস বা চুরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তিতাস এবং অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির চাপে জিটিসিএলের ওপর জোর করে সিস্টেম লস চাপিয়েছে পেট্রোবাংলা।
তিনি বলেন, সঞ্চালন লাইনের মাঝখান দিয়ে ‘হট ট্যাপিং’ করে তিতাস তার গ্রাহকের মিটারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করছে। আগের সরকারের আমলে ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের চাপে এগুলো করা হয়েছে। ওইসব মিটারে জিটিসিএলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে তারা কেন এর দায় নেবে?
বিইআরসির সাবেক সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জিটিসিএল গ্যাস বিক্রি না করায় তাদের সিস্টেম লস থাকার কথা নয়। তাছাড়া সঞ্চালন লাইন এতটাই উচ্চ চাপসম্পন্ন যে, এতে যদি সুই পরিমাণ ছিদ্রও থাকে, তাহলে অন্তত আধা কিলোমিটার দূর থেকে গ্যাস লিকেজের শব্দ শোনা যাবে। এরপরও জিটিসিএলের ওপর লোকসান চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে দুই কারণ থাকতে পারে। এক, পেট্রোবাংলার অজ্ঞতা। দুই, তিতাসের গ্যাসচোরদের সঙ্গে যৌথ ভাগাভাগিতে তারাও জড়িত।’