মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: বাংলাদেশে কি আদৌ কোনো প্রভাব পড়বে?
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এবার বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি। বিশেষ করে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মন্তব্য করার পর আগ্রহ বেড়েছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারাও নিবিড়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ওপর চোখ রেখেছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের পরিবারের সম্পর্কের বিষয়টি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন জোরালো সমর্থন জানিয়েছে। এ সরকারকে সহযোগিতা ও একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস জিতলে এ সরকারের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকতে পারে। সে কারণে কমলা হ্যারিস জয়ী হলে তা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ভালো হবে বলে মনে করে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা।
কমলা হ্যারিসের প্রচার-প্রচারণায় ড. ইউনূসের পারিবারিক বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অনেক বেশি সক্রিয়। তাই কমলা হ্যারিস জয়ী হলে বাংলাদেশ বা ড. ইউনূস ইস্যুতে সাবেকদের পরামর্শই নেবেন কমলা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হলে তাদের জন্য সুবিধা হবে। কারণ তারা মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পেছনে বাইডেন সরকারের হাত রয়েছে।
আওয়ামী লীগ শিবির মনে করছে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ফলে ট্রাম্প বিজয়ী হলে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে ভারত প্রভাবিত করতে পারবে। কমলা জিতলেও মোদির জন্য সুবিধা হবে বলে মনে করছে ভারতীয় গণমাধ্যম। কমলার পৈতৃক ভিটা তামিলনাড়ুতে। তার স্বামীর সঙ্গেও মোদির সম্পর্ক ভালো।
উল্লেখ্য, বর্তমান বাইডেন প্রশাসন শুরু থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সরব আর সক্রিয়। দেশটির কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের দৃষ্টিতে দেখে না।
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কতটা উষ্ণ তা গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাইডলাইন বৈঠকে স্পষ্ট হয়েছে। ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরে বাইডেনের ছবি বিশ্ব দেখেছে। একই সঙ্গে এই সরকারের মধ্যে ট্রাম্পকে নিয়েও কোনো নেতিবাচক বক্তব্য নেই। অপরদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গত চার বছর ধরেই নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযোগ ও সমালোচনায় সরব ছিলেন। সর্বশেষ শেখ হাসিনাও তার সরকারের পতনের জন্য ষড়যন্ত্রের তীর যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ছুড়েছেন।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কারণ সরকার পরিবর্তনে হোয়াইট হাউজের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে এই নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই।
অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে পার্থক্যের জায়গা আছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন সংকটের পটভূমিতে পুরো বিশ্বই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত অবসান হবে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরও তীব্র হতে পারে। তবে ট্রাম্প তার দেশের অর্থনীতির দিকেই যে বেশি মনোযোগ দেবেন সেটা তার নির্বাচনী প্রচারের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। অন্যদিকে ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও কোয়াডকে কতটা গুরুত্ব দেবে সেটা সময়ই বলে দেবে। কারণ এগুলো ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের প্রণয়ন করা।
বিশ্ব গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ সরকারের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক নেতাদের সখ্য বহু পুরনো। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ওপর ডেমোক্রেটিক দলের যে তিনজনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে, তারা হলেন- ক্লিনটন, হিলারি ও বারাক ওবামা। তাই ড. ইউনূস প্রশাসনের সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করতে ক্লিনটন ও হিলারি ভূমিকা রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া কমলা জয়ী হলে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিই চালিয়ে নিতে পারেন।
কূটনীতিকরা বলছেন, বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়। যেমন ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক। কংগ্রেস বিদায় নিয়ে মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। তারা ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী মোদির বোধহয় খুব একটা জমবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একচুলও নড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চেয়ে মোদির বিজেপি শেখ হাসিনার জন্য আরও বেশি ভূমিকা রেখেছে এবং রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।
একজন সাবেক কূটনীতিক বলেন, সব কিছুর পরও ব্যক্তিগত ভূমিকা যে একেবারে কাজ করে না, তা নয়। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জিতলে বর্তমান সরকারের প্রতি সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প জিতলে কী হবে? এই সমর্থন কি চলে যাবে? কূটনীতিকরা অবশ্য তেমনটা মনে করেন না। তবে ট্রাম্পের ওপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা বড় প্রভাব আছে বলে তারা মনে করেন। তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখন যে সম্পর্ক তাতে ট্রাম্প জিতলে নরেন্দ্র মোদি তাকে প্রভাবিত করতে চাইবেন।
বিশ্লেষকদের মতে, তার ফল এমন হবে না যে ট্রাম্প হাসিনা সরকারকে আবার বসাতে চাইবেন। সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে তিনি বাইডেনের নীতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করবেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউক্রেন যুদ্ধ যেকোনোভাবে শেষ করবেন। তবে ইসরায়েল নীতি আরও কড়া হলে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কমলা হ্যারিস মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সরকার আছে তাদের জন্য সুবিধা হবে। তাদের সংস্কারকাজ, নির্বাচন এগুলো করা সহজ হবে। কারণ আগে থেকেই জো বাইডেন সমর্থন দিয়ে রেখেছেন। এক্ষেত্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ইউনূস সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের এই সুসম্পর্ক নাও থাকতে পারে। তবে ট্রাম্প যে সব উল্টে দেবেন তা আমার কাছে মনে হয় না। বুঝতে হবে এই এলাকায় এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মুখোমুখি হয়ে গেছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তার পরিবর্তন হবে। মোদি ফ্যাক্টর কাজ করবে। কারণ ট্রাম্প আর মোদির মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম ইস্যু হলো অভিবাসন। ফলে ট্রাম্প জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আসবে। এতে বাংলাদেশের অভিবাসী, সেখানে যেসব বাংলাদেশি ছাত্ররা পড়তে যান তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ট্রাম্প জয়ী হলে রোহিঙ্গাদের জন্য আগের মতো তহবিল পাওয়া যাবে কি না তাও নিশ্চিত নয়। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই।
ট্রাম্প সম্প্রতি তার এক্স বার্তায় লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
জয়ী হলে ট্রাম্পের এই বক্তব্য কি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার বিদেশ নীতিতে প্রতিফলিত হবে- এ প্রশ্নে হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এটা আসলে ভোটের ব্যাপার। আমরা জানি মার্কিন নির্বাচনে ভারতীয় অভিবাসী এবং অভিবাসী হিন্দুদের একটা ভূমিকা আছে। ট্রাম্প তার কথা দিয়ে হয়তো তাদের ভোট টানতে চাইছেন। এর আগের বারও ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কথা বলেছেন। সেই সময় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার ছিল।’