দুই বছরের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন ইলন মাস্ক
২০২৫ সালে লঞ্চ উইন্ডো ব্যবহার করে মঙ্গলগ্রহে একটি নয়, পাঁচটি মহাকাশযান পাঠাতে চান ইলন মাস্ক।
স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক হলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি নানা কারণে বিতর্কিত। তার উগ্র বক্তব্য, বিলাসবহুল জীবন এবং রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে তিনি অনেকের চোখে এখন একজন ‘জেমস বন্ড’। তার কর্মকাণ্ডে মনে হবে তিনি পৃথিবী জয় করতে এসেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস করতে তিনি বদ্ধপরিকর।
কিন্তু ইলন মাস্কের আরেকটি দিকও আছে। তিনি একজন চমৎকার প্রকৌশলী ও তার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সুদূরপ্রসারী। তার এই সাফল্য হয়ত বিশ্বের অনেক শীর্ষ প্রকৌশলীদের সঙ্গে কাজ করার ফল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে, তার প্রতিষ্ঠান টেসলা ও স্পেসএক্স যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তা-ই তাকে এ সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছে। আর এ তালিকায় যুক্ত হতে যাওয়া নিউরালিঙ্ক নিয়ে আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটিও এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। আর প্রথমবারের মতো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেটের ধারণা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ইলন মাস্ক নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
মাস্ক তার চমকপ্রদ বক্তব্য ও ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য পরিচিত। বাস্তবে দেখা গেছে, হয়ত অনুমিত সময়ের চেয়ে ধীরে হলেও তার অনেক ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালে খুলবে এমন লঞ্চ উইন্ডো ব্যবহার করে মঙ্গলগ্রহে একটি নয় পাঁচটি মহাকাশযান পাঠাবেন। তবে এগুলোতে কোনো মানুষ থাকবে না।
মাস্কের মূল লক্ষ্য হলো প্রতি ঘণ্টায় একটি করে স্টারশিপ সুপার রকেট উৎক্ষেপণ করা। এজন্যই রকেটের নিম্নাংশ লঞ্চ টাওয়ারের কাছে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি তার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ। আর এভাবে এটিকে লঞ্চ প্যাডে রেখে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে, ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন পরিবর্তন করে আবার একে সংযুক্ত করা হবে। এরপর পুনরায় জ্বালানি ভরে রকেটটি উৎক্ষেপণ করা হবে।
প্রশ্ন থেকে যায় যে এমন গতি বজায় রাখা সম্ভব কি-না। আপাত দৃষ্টিতে এটি সম্ভব নয়। কারণ রকেটের নিচের অংশ হেভি বুস্টার এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু দুই বছর পর এটি সম্ভব বলে মনে হতে পারে।
টেক্সাসের বোকা চিকায় ইতোমধ্যে দুটি লঞ্চ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে, যদিও দ্বিতীয়টি এখনও উদ্বোধন করা হয়নি। কেনেডি সেন্টারের র্যাম্প ৩৯এ-তে তৃতীয় লঞ্চ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। যখন এই তিনটি টাওয়ার চালু হবে, তাত্ত্বিকভাবে স্পেসএক্স একযোগে তিনটি সুপার হেভি বুস্টার উৎক্ষেপণ করতে পারবে।
সুপার হেভি বুস্টার পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং প্রতিটি মিশন ঘণ্টার চার ভাগের এক ভাগ সময়ে সম্পন্ন করতে সক্ষম। এ সময়ের মধ্যেই সুপার হেভি বুস্টার ৭০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে এবং আস্তে ধীরে লঞ্চ টাওয়ারে ফিরে আসতে পারে।
সুতরাং স্পেসএক্সের জন্য তিনটি লঞ্চারই যথেষ্ট। আর সতর্কতা স্বরূপ আরও দুই-তিনটা লঞ্চার রাখা যেতে পারে। সর্বোপরি, এগুলো তুলনামূলকভাবে কম খরচে তৈরি করা সম্ভব। তবে এর সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ হলো প্রপালশন প্ল্যান্ট, যাতে ৩৩টি র্যাপটর ইঞ্জিন রয়েছে।
বর্তমানে স্পেসএক্স প্রতিদিন একটি ইঞ্জিন তৈরি করছে। তবে ৩ডি প্রিন্টার ব্যবহার করে তৈরি করা নতুন একটি মডেল চালু হলে এর উৎপাদন দ্বিগুণ হতে পারে।
উৎক্ষেপণে তাড়াহুড়ো কেন? কারণ দ্বিতীয় স্টেজ, যার মধ্যে স্টারশিপও রয়েছে, শুধু পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি বহন করতে পারে। চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার ভবিষ্যত মিশনগুলোতে যেতে হলে মাঝপথে জ্বালানি হিসেবে মিথেন ও অক্সিজেন প্রয়োজন হবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া এবং এটি এখনো পরীক্ষা করা হয়নি।
স্পেসএক্সের প্রকৌশলীরা ইতোমধ্যেই একটি দ্রুতগামী ট্যাঙ্কার মহাকাশযান ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। এটি সয়ংক্রিয়ভাবে প্রধান মহাকাশযানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দ্রুততম সময়ে ট্যাংক পূরণ করবে, যাতে বাষ্পীভবনজনিত ক্ষতি এড়ানো যায়। আর প্রতিটি আন্তঃগ্রহ যাত্রার জন্য ছয় থেকে ১২টি মালবাহী যান প্রয়োজন হতে পারে, যেগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য নাও হতে পারে।
মাস্কের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি রিচার্জ উৎক্ষেপণে খরচ কম হবে। প্রথম ধাপ হবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। কিন্তু এগুলো যেহেতু পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এক্ষেত্রে খরচ কমবে। দ্বিতীয় ধাপটি মূলত একটি আবরণ যা বোকা চিকায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে সরাসরি র্যাম্পের পাশেই তৈরি হয়। এটি সস্তা এবং দ্রুত নির্মাণ যোগ্য, কারণ এটি অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয় বা কার্বন ফাইবারের মতো হালকা উপাদানের পরিবর্তে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়। যদিও এর অনেক তথ্য এখনও গোপন রাখা হয়েছে। তবে মনে হচ্ছে স্পেসএক্স এই আবরণগুলো পর্যায়ক্রমে লাগানো হয়। আর এগুলো যেহেতু রোলিং মিল থেকে আসে, তাই ধারণা করা হচ্ছে এগুলো সরাসরি মেটাল কয়েল লাগানো হয়।
তবে বাধার কারণ হতে পারে জ্বালানি। কারণ প্রতি ঘণ্টায় রকেট উৎক্ষেপণ করতে হলে প্রয়োজন হাজার হাজার লিটার মিথেন ও অক্সিজেন। বর্তমানে লঞ্চ টাওয়ারের পাশে থাকা ‘ট্যাংক ফার্ম’ একটি রকেট পূরণ করতে যথেষ্ট। তবে দ্রুত পরপর কয়েকটি রকেটের জন্য এটি যথেষ্ট নয়। যেহেতু বোকা চিকা এবং কেনেডি উভয়ই উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত, তাই কেউ কেউ প্রস্তাব করছেন যে একটি জেটি এবং ছোট গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা হোক যাতে বড় মিথেন ট্যাংকারের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ করা যায়।
সবকিছু বিবেচনা করে দেখ যায়, কক্ষপথের জ্বালানি ট্যাঙ্কারগুলোও হতে হবে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। আর এগুলোকে অবশ্যই তাপ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। আর প্রতিটি ট্যাঙ্কারে যদি ছয়টি ইঞ্জিন থাকে, সেগুলোও পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে। যদিও এগুলোতে খুব বেশি খরচ হয় না। তাই সময় বাঁচাতে চাইলে, মাস্ক এগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে এটিই প্রথম নয়। সম্প্রতি ইউরোপা ক্লিপার উৎক্ষেপণে স্পেসএক্স মহাকাশযানটি জ্বালানির শেষ বিন্দু ব্যবহার করে সর্বোচ্চ গতি তোলার জন্য রকেটের তিনটি অংশই ফেলে দিয়েছে।
তাই যাই হোক না কেন, প্রথম পর্যায়ের সফল ক্যাপচারের পরে পরবর্তীতে মহাকাশে জ্বালানি সরবরাহের প্রচেষ্টা খুব জটিল হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার আগে চাঁদে যাওয়া মাস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের অধীনে মানুষসহ চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাই মাস্কের ডাইরিতে মঙ্গলগ্রহে কবে যাবেন সে তারিখ লেখা না থাকলেও চাঁদে যাওয়ার তারিখ লেখা আছে।