চড়া সুদে নাকাল ব্যবসায়ীরা
দফায় দফায় ঋণের সুদহার বাড়ানোয় চরম সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। ফলে ব্যবসা প্রসারসহ থমকে রয়েছে বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই।
বরং ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার লড়াই করছেন। তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বা রেপো রেট আরো ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদ। এতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এলসি খোলার হার কমেছে ৭ শতাংশ আর উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য নয়—এমন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা।
শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশলের যৌক্তিকতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন।
বিনিয়োগ কমে যাওয়া, আমদানি-রপ্তানিতে নিম্নগতি ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফলে টান পড়েছে শিল্পোদ্যোক্তাদের আয়ের খাতে। এদিকে কাঙ্ক্ষিত উপার্জন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো ব্যাংকঋণের কিস্তি দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। কারণ বিভিন্ন কারণেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে হু হু করে।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়া মানে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়া। এমনিতেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বেশি সুদ দিয়ে আসছিল। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ী সমাজ। কোথায় কত টাকা খরচ হবে এবং কতটা মুনাফা হতে পারে, সেটা হিসাব করে আমরা বিনিয়োগ করি। কিন্তু মাঝপথে যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের গলা টিপে হত্যা করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এত দিন ছয়টি কিস্তি দিতে না পারলে একজন গ্রাহক খেলাপিতে পরিণত হতো। গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলে খেলাপি করার শর্ত দেওয়া হয়েছে। আবার আগামী মার্চ (২০২৫) মাস থেকে একটি কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলেই খেলাপি করা হবে।’
উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে মাজা সোজা করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বোঝা এসে পড়ে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে। গত বছরের প্রথম দিকে যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিতে সংকট দেখা দেয়। এরপর ডলার সাশ্রয়ে আসে আমদানিতে কড়াকড়ি।
২০২২ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪১.১৭ শতাংশ।
ডলার সংকটে সময়মতো এলসি করতে না পারা, জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে কারখানার উৎপাদন নেমেছে শূন্যের কোঠায়। জ্বালানিসংকটে উৎপাদন ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বন্ধ ছিল। কারখানায় বিক্ষোভ, হামলা-মামলার কারণে ভারী শিল্প, পোশাক ও টেক্সটাইল খাত মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে। এসব সংকটের কারণে অর্থনীতিতে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, এলসি বা ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে (জুলাই-সেপ্টেম্বর)। এ সময়ে আমদানি করা হয়েছে শুধু শিল্পের কাঁচামাল। ফলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মোট আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। একইভাবে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ কমেছে ২.৫০ শতাংশের মতো।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১০.৮৭ শতাংশ। গত তিন মাসে, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে, দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে। কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পলিসি রেট বাড়াচ্ছে। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকঋণের সুদ বেড়েছে এবং ঋণ নেওয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের মে মাসের পর থেকে এই নিয়ে ১১ বারের মতো নীতি সুদহার বাড়ানো হলো। আর নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মোট তিনবার বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘নীতি সুদহার না বাড়িয়ে কোনো উপায় ছিল না বা এখনো নেই। গত চার-পাঁচ বছরে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের রাখতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়নাসহ সবাই ক্রমান্বয়ে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এখন ওই সব দেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে, তাই তারা নীতি সুদহার কমাতে শুরু করেছে। আমাদের দেশেও কমবে। সুতরাং আমরা যেহেতু একটা ক্রিটিক্যাল সময় পার করছি, তাই এখন অপেক্ষা করা উচিত।’
সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নীতি সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির যে চাপ ছিল সেটা কমে এসেছে। এটা সম্ভব হয়েছে নীতি সুদহারের মাধ্যমে। কিন্তু এত দিন আমাদের দেশে এটাকে বাড়ানো হয়নি। আমরাও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব বলে আশাবাদী। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে।’
গভর্নর আরো বলেন, ‘যখন ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ ছিল তখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার তারও আগে যখন সুদের হার ১৫ শতাংশ ছিল তখন কি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল না? ছিল। সুতরাং শুধু সুদহার বাড়ালেই যে মূল্যস্ফীতি কমবে, বিষয়টি এমন নয়। যখন সুদহার ১৫ শতাংশ ছিল তখন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও ছিল। আমরাও সেখানেই যেতে চাই। এর জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এখন চাইলেও কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি হবে না।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণের কোনো উপায় নেই। ব্যবসায়ীরা আগের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এর কারণ আর্থিক অস্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সুদের হার বৃদ্ধি ও জ্বালানি সংকটে ভুগছে পুরো শিল্প খাত। ভুল নীতি, অপতথ্য বা যেকোনো কারণে যেন দেশের শিল্প ধ্বংস হয়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখা উচিত। কেননা একটা শিল্প প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সেটা জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়।’