Bangladesh

ট্রাম্পের নামে হাসিনার ‘ফেইক’ নিউজ

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দিল্লির খুঁটির জোরে সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে ভারতে গিয়ে এখন আছেন দিল্লির হেফাজতে। নরেন্দ্র মোদির প্রযোজনায় শেখ হাসিনার পরিচালনায় একের পর এক ষড়যন্ত্র কার্ড খেলেও ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে কাবু করতে পারেননি। এখন দিল্লির হেফাজতে থেকেই নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে ড. ইউনূসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আর এটা করতে গিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় একের পর এক ‘ফেইক’ তথ্য প্রচার করছেন।

প্রচার করা হয় যে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’। আরেক টুইটে ট্রাম্প লিখেছেন, “বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বর’ সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছেন। এসবের নিন্দা জানিয়ে টুইটটিতে ট্রাম্প আরো লিখেন, বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ ‘বিশৃংখল’ অবস্থার মাঝে রয়েছে।” ট্রাম্পের নামে এই টুইট ও বক্তব্য পরিকল্পিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হয়। শুধু তাই নয়, ভারতের কিছু গণমাধ্যম ও বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অনুসারী কিছু গণমাধ্যম ট্রাম্পের নামে ওই টুইট ও ‘ফেইক’ বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করছে। উদ্দেশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন। জো বাইডেন, হিলারি ক্লিনটনের বন্ধু হওয়ায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ট্রাম্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানে দেখা যায়, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দূরের কথা ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সপ্তাহ দুয়েক আগে। ‘শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ ট্রাম্পের নামে ভাইরাল উক্তিটি একবারেই ভুয়া।

১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ফোন করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দিয়ে মিছিল করে সে মিছিলে হামলা হলে যেন ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হয় এবং সেটা ভিডিও করে যেন তার কাছে পাঠানো হয়। তিনি ওই ভিডিও ট্রাম্পের কাছে পাঠাবেন। হাসিনা দাবি করেন ট্রাম্পের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার এই দাবি সর্বৈবই মিথ্যা।

‘শেখ হাসিনাকেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প’ এমন একটি উক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। পোস্টটিতে সূত্র হিসেবে কমেন্টবক্সে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ন্যাশনাল ডায়ালগস’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত একটি ভিডিওর লিংক। ফ্যাক্টচেক সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এই পোস্ট করা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য দাবি করে এতে লেখা, ‘আমি মনে করি শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’। পিবিডি ব্রডকাস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কথা বলেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের অবৈধ দখলদার সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যারা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, তারা আমাকে পদত্যাগপত্রটি দেখান।’ পোস্টটিতে দাবি করা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তানে কি হচ্ছে আমি সব জানি। এখানে সন্ত্রাসবাদের চাষাবাদ হচ্ছে।’

নুরুল আজিম রনি তার পোস্টটির সূত্র হিসেবে কমেন্টবক্সে যে ‘ন্যাশনাল ডায়ালগস’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের লিংক দিয়েছেন, সেটি কার্যত ভারতীয় একটি ইউটিউব চ্যানেল। তরুণ ঘোষ নামে কলকাতার একজন সাংবাদিক এই চ্যানেলে নিয়মিত মতামত ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ করেন। চ্যানেলটিতে প্রচারিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘আমি মানি হাসিনা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী : ট্রাম্প’। তরুণ ঘোষ দাবি করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প জেতার পর গত শনিবার একটি পডকাস্টে যোগ দিয়েছিলেন। পিবিডি পডকাস্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউটিউব চ্যানেলে এর আয়োজন করা হয়। পডকাস্টে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরেন ট্রাম্প। পডকাস্টটিতে কিছু কিছু ব্যক্তিকে ট্রাম্প শত্রুর তালিকায় রেখেছেন। এ তালিকায় এক নম্বরে আছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। এরপরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি…।’ তরুণ ঘোষ আরো দাবি করেন, ট্রাম্প বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, এখানে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছে এবং এখানে সন্ত্রাসবাদের একটা বীজ বোনা হচ্ছে।’ বাস্তবতা হচ্ছে ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনো মন্তব্য করেননি। মূলত নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে ১৭ অক্টোবর তিনি ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে পিবিডি পডকাস্টের ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাম্পের পডকাস্টটি দেখা যায়। চ্যানেলটিতে ১৭ অক্টোবর পডকাস্টটি প্রচার করা হয়। ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের পডকাস্টটিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বারাক ওবামার ভূমিকা, কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের ভূমিকা, ইরানের ওপর অবরোধ, পররাষ্ট্র নীতি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প জানান, তার সঙ্গে পুতিন ও জেলনস্কির ভালো সম্পর্ক রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্যোগী হবেন। পুরো পডকাস্টটিতে তাকে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো আলোচনা করতে শোনা যায়নি। বাংলাদেশ বা শেখ হাসিনা সম্পর্কে মন্তব্য করেননি। অথচ ট্রাম্পের বক্তব্য হিসেবে ‘ফেইক’ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।

হাসিনা ও তার অলিগার্ক মিডিয়া প্রচার করছে ড. মুহম্মদ ইউনূসের হচ্ছে বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন ও জো বাইডেনের বন্ধু। হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ড. ইউনূস ক্লিনটন ফাউণ্ডেশনে অর্থ দিয়েছেন। জো বাইডেন প্রশাসনের ড. ইউনূস সমাদৃত। এ সব প্রচার করে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হাসিনা বাড়তি সুবিধা নিতে চাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি শেখ হাসিনার মার্কিন বিরোধী বক্তব্যগুলোর কথা ভুলে গেছে? তাছাড়া ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল সেলফি কাহিনী? ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী তখন বাংলাদেশের হাইকোর্ট তাকে ‘রং হেডেড পার্সন’ তকমা করেছিলেন। তাই হাসিনা সকলকে নিজের মতো রং হেডেড মনে করেন? ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতের দিল্লিতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব কোন পর্যায়ে গেছে যে তিনি নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুকম্পায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে চাচ্ছেন। আর এ জন্য তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য ভাইরাল করছেন। তার পক্ষে ভারতের কিছু গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশের তাবেদার কিছু মিডিয়া সেই মিথ্যাকেই ‘সত্য’ প্রমাণের চেষ্টায় ফলাও করে প্রচার করছেন।

জার্মানির এডলফ হিটলারের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন পল জোসেফ গোয়েবল্স। তার থিউরি হচ্ছে মিথ্যা+মিথ্যা+ মিথ্যা=সত্য। গোয়েবলস বলতেন, একটি মিথ্যাকে দশবার বললে তা সত্যের মতো শোনায়। মাদার অফ মাফিয়া হাসিনা সেই গোয়েবলসীয় থিউরি হাজির করছেন। কবি লিখেছেন, ‘দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় কখনো ভুলিতে নাই’। অতএব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাবধান! ফ্যাসিস্ট হাসিনার মিষ্টি কথা বিশ্বাস করবেন না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button