ইলন মাস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্টের বন্ধুতালিকায় এক নম্বরে
ইলন মাস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী বেসরকারি নাগরিকে পরিণত হয়েছেন।
‘ওকে এখান থেকে বের করতেই পারছি না,’ বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডার পাম বিচে নিজ বাসভবন মার-এ-লাগোতে এক অনুষ্ঠানে এভাবেই ইলন মাস্ককে নিয়ে কৌতুক করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি মাস্ক এখন সদ্য-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, এক মুহূর্তের জন্যও ট্রাম্পের পাশ ছাড়ছেন না তিনি।
এক সমাবেশে ট্রাম্পের পাশে তো আরেক সমাবেশে মেলানিয়ার পাশে ইলন মাস্ক; বিজয় উদযাপন পার্টিতেও তিনি আছেন; ট্রাম্পের সঙ্গে ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রথম ফোনকলেও মাস্ক; টেনর ক্রিস ম্যাকিওর সঙ্গে গানের আসরে, হোয়াইট হাউজে জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ট্রাম্পের বিমানে ওয়াশিংটনের পথে, ইরানি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে, এমনকি মার-এ-লাগোতে ট্রাম্প ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের সঙ্গে — সর্বত্র ইলন মাস্ক উপস্থিত।
‘আমি ফার্স্ট বাডি হতে পেরে গর্বিত!’ অনানুষ্ঠানিকভাবে এ খেতাব পাওয়ার পর এক টুইটে এমন মন্তব্য করেন মাস্ক। শব্দটি পরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পের নাতনি কাই ট্রাম্প রসিকতা করে বলেন, ‘ইলন চাচার মর্যাদা পাচ্ছেন।’ ট্রাম্প পরিবারের বিজয় উদযাপন অনুষ্ঠানে নিজের ছেলের সঙ্গে ছবি তুলে এক্স-এ পোস্ট করেছেন এ বিলিয়নিয়ার। সেখানে ট্রাম্পকেও ইলনের ছেলের সঙ্গে ছবি তোলার ইচ্ছের কথা বলতে শোনা যায়।
মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর মালিক, ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও প্রভাব, ফেডারেল নিয়মনীতি ও সংস্থাগুলো সংস্কারে তার মিশন এবং টেসলা, স্পেসএক্স, এক্সএই ও এক্স-এর প্রধান হিসেবে ইলন মাস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী বেসরকারি নাগরিকে পরিণত হয়েছেন।
নির্বাচনের পর থেকে মাস্ক তার বেশিরভাগ সময় ট্রাম্পের প্রাসাদোপম ক্লাবহাউজ মার-এ-লাগোতেই কাটাচ্ছেন। ৫ নভেম্বর তার ব্যক্তিগত জেট ওয়েস্ট পাম বিচের নিকটবর্তী বিমানবন্দরে অবতরণ করে এবং প্রায় ২৪ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে। বুধবার মাস্ক ট্রাম্পের বিমানে করে ওয়াশিংটনে যান। তার নিজস্ব বিমানটি তাকে অনুসরণ করে বিকেলে ফ্লোরিডায় ফিরে আসে।
ওয়াশিংটনে আইন প্রণেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প মজা করে বলেন, মাস্ক এখন তার ছায়ায় পরিণত হয়েছেন: ‘ইলন বাড়ি যেতেই চাচ্ছেন না। আমি তাকে ছাড়াতে পারছি না।’ ওই বৈঠকে ট্রাম্প মাস্কের প্রশংসা করেন। কংগ্রেস সদস্যদের কাছ থেকে অভিবাদন পান মাস্ক। এরপর মার-এ-লাগো ক্লাবের ডাইনিং রুমে পৌঁছালেও সমান উষ্ণ অভ্যর্থনা জোটে তার।
গত কয়েক দিনে ট্রাম্পের পাশে প্রায় সবসময় থেকে মাস্ক নতুন নীতি, মন্ত্রিসভা নিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তার মতামত জানিয়ে আসছেন। কিছু মার্কিন সংবাদমাধ্যমের মতে, ক্ষমতা স্থানান্তর প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকা হাওয়ার্ড লুটনিক এবং লিন্ডা ম্যাকমোহনের চেয়েও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। তার এ প্রভাব অন্যান্য নিয়মিত ট্রাম্প সমর্থকদের মাঝে কিছু ভুল ধারণা বা সরাসরি ঈর্ষার কারণও হয়েছে।
রিপাবলিকানদের ভূমিধস বিজয়ে নিজের অবদান নিয়ে সচেতন মাস্ক। ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতটি সুইং স্টেটে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করেন এবং জনপ্রিয় ভোটেও প্রায় ৩০ মিলিয়ন ভোটের ব্যবধানে (মাত্র দুই পয়েন্টের কম) জয় লাভ করেন।
মাস্ক তার সংস্থা আমেরিকা পিএসি-এর মাধ্যমে তিনি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ট্রাম্পের প্রচারণায় অবদান রাখেন। তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ট্রাম্পের প্রচারণা নিয়মিত শেয়ার করেছেন মাস্ক। এক্স-এর অ্যালগরিদমও ট্রাম্পপন্থীদের বার্তা প্রচারে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
জুন মাসে টেসলার শেয়ারহোল্ডারদের এক বৈঠকে রিপাবলিকানদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলেন মাস্ক। তিনি জানান, ট্রাম্প মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে ফোন করেন। ‘উনি আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই ফোন করেন। কেন করেন, তা আমি জানি না, তবে উনি করেন।’
ট্রাম্প প্রশাসনে কোন পদের প্রতি তার আগ্রহ, সেটা আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মাস্ক। অক্টোবরে পেনসিলভানিয়ায় এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের “ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি” [সংক্ষেপে ডোজ] দরকার।’
এ তথাকথিত ‘ডোজ’ বিভাগের নেতৃত্বে সম্প্রতি দুজনের নাম ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প — ইলন মাস্ক এবং প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রাইমারি প্রার্থী বিবেক রামাস্বামী। তবে ‘ডোজ’ কোনো সরকারি বিভাগ নয়। এটি কেবলমাত্র একটি তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান — কীভাবে বা কোন আইনি কাঠামোর অধীনে এটি কাজ করবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ট্রাম্প শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন, এটি হোয়াইট হাউজ ও অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেটের সঙ্গে ‘অংশীদারিত্বে’ কাজ করবে। যেহেতু এটি কোনো আনুষ্ঠানিক পদ নয়, তাই মাস্ক ও রামাস্বামীর কাজের জন্য কোনো সিনেট অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।
অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ এড়ানো এবং সরকারি সংস্থাগুলোর ক্ষমতা কমানো সম্ভব হলে মাস্কের বেশ কয়েকটি কোম্পানি সুবিধা পেতে পারে। স্বচালিত গাড়ি তৈরিতে মার্কিন নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব আছে, এক্ষেত্রে নতুন নিয়মাবলী টেসলার জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। স্পেসএক্সে রকেট উৎক্ষেপণ, এক্সএআই-তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশ এবং নিউরালিংকে মস্তিষ্কে কম্পিউটার ইমপ্লান্টের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মতো উদ্যোগেও সুবিধা পেতে পারেন তিনি।
মাস্ক ফেডারেল বাজেটের প্রতিটি খাত যাচাইয়ের বিশাল কাজে সহায়তার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করতে চান। তিনি এমনকি বলেছেন, ৬.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ফেডারেল ব্যয়ের দুটি খাতে কাটছাঁট করা সম্ভব, যদিও কীভাবে তা করবেন, তা তিনি উল্লেখ করেননি।
এ খাতগুলোর বেশিরভাগই ঋণের সুদ (যা কাটা সম্ভব নয়), সামরিক ব্যয় (যা ট্রাম্প বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন), এবং সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, যেগুলো বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প।
ইলন ও বিবেক হয়তো কিছু অপ্রয়োজনীয় খরচ খুঁজে পাবেন, কিন্তু প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সরকারি ব্যয় কমানো বলা যত সহজ, করা তত কঠিন। যারা মাস্ক ও রামাস্বামীর সঙ্গে যোগ দেবেন, তাদের জন্য এ কাজটি হবে ক্লান্তিকর ও অবৈতনিক—এ কথা তারা দুজনেই স্বীকার করেছেন। ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি-এর এক এক্স পোস্টে স্বেচ্ছাসেবী আহ্বান করা হয়েছে—এমন স্বেচ্ছাসেবী, যারা সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা কাজ করতে প্রস্তুত।
দুই বিলিয়নেয়ারের ওপর অর্পিত এ মিশনে শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে: ২০২৬ সালের ৪ জুলাই, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ২৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হবে। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির মধ্যে এ সম্পর্ক ততদিন টিকে থাকবে কি না, নাকি একই খাঁচার দুই মোরগের মতো তারা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বেন, তা সময়ই বলে দেবে।