গোলানি ও এইচটিএস: তাদের হাতে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ?
লেবানন ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে ২৭ নভেম্বর যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে ইসরায়েল। একই দিনে সিরিয়ার ইদলিব থেকে বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)।
মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ যুদ্ধে সিরিয়ায় সমাপ্তি ঘটেছে আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনকাল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছেন এইচটিএস প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি। এই গোলানি আসলে কে? তার গোষ্ঠী এইচটিএসই বা কেমন আদর্শে বিশ্বাস করে?
ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত
আরব গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, গোলানির আসল নাম আহমেদ হুসেইন আল সারা। জন্ম ১৯৮২ সালে, সৌদি আরবে। তার পরিবারের আদি নিবাস সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে। ১৯৬৭ সালে ছয়দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এই মালভূমি দখল করে ইসয়ায়েল। তখন বাস্তুচ্যুত হয় তার পরিবার। ৮০’র দশকে আবার সিরিয়ায় ফেরত আসে তার পরিবার।
ধারণা করা হয়, গোলান মালভূমির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্তার জানান দিতেই পরে নামের সঙ্গে গোলানি যুক্ত করেন বর্তমান এইচটিএস প্রধান।
আল কায়দা ও আইএসের সাবেক সৈনিক
২০০৩ সালে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইরাকে যান গোলানি। ধরা পড়েন মার্কিন সেনাদের হাতেও। আলজাজিরা জানায়, ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন কারাগারে ছিলেন তিনি।
২০১১ সালে আসাদ-বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সিরিয়ায় ফেরত আসেন গোলানি। ইরাকের ইসলামিক স্টেটের তৎকালীন প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির পরামর্শে বিদ্রোহী-অধ্যুষিত ইদলিবে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আল কায়দার সিরিয়া শাখা আল নুসরা ফ্রন্ট।
২০১৩ সালে আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আইএস। সঙ্গে সঙ্গে আল নুসরাকেও আইএসের অংশ বলে দাবি করে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন গোলানি। তিনি আল কায়দার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখেন।
একই বছর গোলানি ও নুসরা ফ্রন্টকে জঙ্গি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৪ সালে গণমাধ্যমকে প্রথম সাক্ষাৎকার দেন গোলানি। আল জাজিরাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে বেশ উগ্রপন্থী বক্তব্য দিতে শোনা যায় তাকে। সিরিয়ায় শরিয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশ থেকে খ্রিস্টান ও আলাওয়ি সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করার ডাক দেন তিনি।
আল কায়দা থেকে বিচ্ছেদ, বিদ্রোহীদের নেতা
২০১৬ সালে ইরান ও রাশিয়ার সরাসরি সমর্থনে সিংহভাগ প্রদেশে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। আল কায়দা ও আইএসও দুর্বল হয়ে পড়ে।
আলেপ্পোর পতনের পর বিদ্রোহী অধ্যুষিত ইদলিবে আশ্রয় নেন গোলানি। সেখানে গিয়ে আল কায়দা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ডাক দেন। নুসরা ফ্রন্টের নাম বদলে রাখেন জাবাত ফাতেহ আল-শাম।
২০১৭ সালে নিজের গোষ্ঠী ও ইদলিবে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহীদের নিয়ে এইচটিএস জোট প্রতিষ্ঠা করেন গোলানি। এই জোটই ২০১৭ থেকে ইদলিব শাসন করে আসছে।
স্থানীয় গণমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, গত সাত বছর শক্ত হাতেই ইদলিব শাসন করেছে এইচটিএস। প্রশাসনের সমালোচকদের গুম, খুনের পাশাপাশি বিরোধিতাকারী জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া বন্ধ রাখার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
সুর পাল্টে ‘মধ্যপন্থী’ গোলানি
নভেম্বরে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আকস্মিক অভিযান শুরু করার পর সুর পালটেছেন গোলানি। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি দাবি করেন, আগের ‘বৈশ্বিক খেলাফত’ ও আল কায়দা-আইএসের মতাদর্শ থেকে সরে এসেছেন।
সিএনএনের সাক্ষাৎকারে গোলানি বলেন, বিদ্রোহীদের সরকারে সিরিয়ায় অবস্থানরত সকল গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের আইনগতভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে। নতুন সরকারে সবাইকে জায়গা দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
গত কয়েকদিনে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাকে ‘মধ্যপন্থী’ ও ‘বাস্তববাদী’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
সিরিয়া বিশেষজ্ঞ হাসান হাসানের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানায়, গোলানি এইচটিএসকে একটি বিশ্বস্ত শাসক গোষ্ঠী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তারা ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে’, এমন ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করছে পশ্চিমা বিশ্বকে।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে কাদের পক্ষে এইচটিএস?
সিরিয়ায় আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর দেশটিতে অনেকগুলো আসাদ-বিরোধী গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মধ্যে কুর্দি বিদ্রোহীদের পাশাপাশি বেশ কিছু গোষ্ঠীকে সরাসরি সমর্থন দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ২০১৭ সালে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার মিশন বন্ধ করে দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।
এরপর থেকে বিদ্রোহীরা মূলত তুরস্কের কাছ থেকেই সমর্থন পাচ্ছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। তবে বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সাহায্য করলেও এইচটিএসকে জঙ্গি গোষ্ঠীর তালিকায় রেখেছে তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘও তাদের জঙ্গিগোষ্ঠীর তালিকায় রেখেছে।
তবে আসাদ-বিরোধী যুদ্ধে এইচটিএসের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পরোক্ষ সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, এইচটিএস কখনো ইসরায়েলে আক্রমণ করার হুমকি দেননি। এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি আরও দাবি করে, ২০২১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন কূটনীতিক জেমস জেফরি বলেছিলেন, ইদলিবের বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে গোলানিই ‘সবচেয়ে কম খারাপ’।
শুক্রবার টাইমস অব ইসরায়েলে একজন বিদ্রোহী সেনা কমান্ডারের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে বিদ্রোহী কমান্ডার সরাসরি ইসরায়েল সরকারকে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দাবি করেন, ইসরায়েলের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ রাখতে চায় বিদ্রোহীরা।
আজ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আসাদের পতনকে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সাফল্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশটিতে থাকা তাদের সামরিক ঘাঁটি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে, আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ইরান, রাশিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রভাব একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে।
সামনে বিদ্রোহী সরকারের পররাষ্ট্র নীতি কেমন হবে, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে আল জাজিরার প্রতিবেদন ও সিএনএনের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, গোলানি একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ তৈরির ব্যাপারেই বদ্ধপরিকর। সেই প্রজাতন্ত্র শরিয়া আইন কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।