মায়ের ডাকের গণজমায়েতে নেতারা হাসিনার বিচারে চাই ঐক্য
ফ্যাসিস্টদের বিচারের আগে নির্বাচন হবে না * ১৬ বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কী করেছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে * মামলা বাণিজ্য বন্ধে নেতাদের কঠোর হওয়ার আহ্বান
আওয়ামী লীগের মেয়াদে গুম-খুন, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরসহ জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে। এসব গুম ও গণহত্যায় শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিচারের জন্য ঐক্যের বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার বিচারের আগে কোনোভাবেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। এ সময়ে কেউ শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করলে জাতি তাদেরও বেইমান হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক গণজমায়েত থেকে এমন দাবি জানানো হয়। গুমের শিকার স্বজনদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ জুলাই গণহত্যা, জোরপূর্বক গুম, ক্রসফায়ার, পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, মোদিবিরোধী আন্দোলন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ)-সহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জুলুমের শিকার ভুক্তভোগীদের নিয়ে এ আয়োজন করে।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের বুকফাটা কান্না আর আর্তনাদে এদিন ভারী হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। মঞ্চে গুমের শিকার পরিবারের শিশুসন্তান হৃদি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর আমার বাবা গুমের শিকার হন। আমাদের কী দোষ ছিল যে, বাবাকে দেখতে পাইনি। অভ্যুত্থানে নিহত শিশু আনাসের বাবা তার ছেলের লেখা চিঠি পড়ে শোনান। নিখোঁজদের স্বজনের পাশাপাশি মঞ্চে এসে স্মৃতিচারণা করেন ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন ও আহত যোদ্ধারা। অনুষ্ঠান শুরুর পর মুহূর্তেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নীরবতা নেমে আসে। স্বজন হারানোর ব্যথায় অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়। এক মা তার সন্তান, না হয় সন্তানের হাড়গোড় দেওয়ার দাবি জানান। আপনজন হারানো মানুষগুলোর কেউ কেউ মাইকে এসে ঠিকমতো কথা বলতে পারেননি। তাদের ভাষাগুলো কান্না হয়ে ঝরেছে। সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে উদ্যানজুড়ে। কান্নাচাপা কণ্ঠে, মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে দাবি জানিয়েছে-বিচার চাই। খুন, অপহরণ, গুমের জন্য দায়ী স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের দল-মত, আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু নিপীড়ত মানুষকে এক থাকতে হবে। এই এক থাকার জন্য একটি জাতীয় মঞ্চ গঠন করা প্রয়োজন। শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও তাদের মুজিববাদী রাজনীতি একটি ফ্যাসিস্ট রাজনীতি। সেই রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে তারা মানবাধিকার হরণ করেছিল। পুরো বিশ্বকে এটি বলতে হবে-তারা মানবতাবিরোধী দল এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু জুলাই আন্দোলনে নয়, ক্ষমতার শুরু থেকেই তারা গণহত্যা ও মানবাধিকার হরণের সঙ্গে জড়িত ছিল। শেখ হাসিনার হাতে রক্তের দাগ সবসময়ই ছিল, যা আগে ছিল তার বাবার হাতে। আমরা পিলখানা ও শাপল চত্বরে নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখেছি। সর্বশেষ জুলাই আন্দোলনে গণহত্যা দেখেছি। শেখ মুজিব যখন ক্ষমতায় ছিলেন, সেই একইভাবে বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রকে হরণ করে হত্যা করেছিল। তারা দুবার ক্ষমতার সুযোগ পেয়েই গণহত্যা চালিয়েছে। ফলে তাদের রাজনীতি করার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের বিদায় হয়ে গেছে। এখন যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চান, জনগণ তাদেরও বাংলাদেশের শত্রু হিসাবে চিহিত করবে। আমাদের নিপীড়িতদের এখন একটাই ঐক্যের জায়গা, সেটি বিচার। ফ্যাসিস্টরা গণহত্যা করেছে, তার বিচারের জন্য আমরা কাজ করব। আজ রক্তের যে প্রতিশ্রুতি, সেই বিচার আমরা অবশ্যই করব। এর জন্য জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতি সবসময় রক্ষা করতে হবে। সব নিপীড়ন, হত্যা, গুম-খুনের বিচার এই সরকারের সময়ই করব। মামলা বাণিজ্য বন্ধে সিনিয়র নেতাদের কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ভারতকে উদ্দেশ করে নাহিদ বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার দেশ নয়। বাংলাদেশ তার আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্তের ওপর দিয়েই দাঁড়িয়েছে। ফলে এখন থেকে সমতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যদি মনে করেন, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা করে চাপ তৈরি করবেন, তাহলে ভুল ভাবছেন। সীমান্ত সুরক্ষা করতে হলে আমরা সেখানেও ছুটে যাব। বাংলাদেশকে নিয়ে অপপ্রচার বন্ধের আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে লড়াই করেছি। অনেক সংখ্যালঘু শেখ হাসিনার বাহিনীর হাতে শহিদ হয়েছেন। তাদের সম্পদ দখল হয়েছে, অথচ ভারত তখন আওয়ামী লীগকে কিছুই বলেনি। এই দেশ, এই মাটি আমাদের। ফলে আমাদের একসঙ্গেই ঐক্যবদ্ধভাবে বেঁচে থাকতে হবে, লড়াই করতে হবে। তিনি ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার হরণের নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববাসীকে নির্যাতিত দেশটির পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। গণজমায়েতে তারেক রহমানের লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান ইসরাক হোসেন। লিখিত বক্তব্যে গুম, খুন, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সহমর্মিতা প্রকাশ করে জড়িতদের বিচার দাবি করেন। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ পরিচালিত হবে বলে মন্তব্য করেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ভিডিও বার্তায় গুম-খুনের বিচারসহ জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
জামায়াত ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার বলেন, সব গুম-খুনের মাস্টার শেখ হাসিনার বিচার করতে হবে। গত ১৬ বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি করেছে সেই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশাসন থেকে স্বৈরাচারের দোসরদের সরিয়ে দেওয়া ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেন।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, জনগণের টাকায় কেনা গুলি কারা ব্যবহার করেছে, পুলিশকে কারা ব্যবহার করেছে, সেটি বের করতে হবে। ফ্যাসিবাদের আমলে আলেমদের জেলে নেওয়ার সময় কোমরে রশি বাঁধা থাকত। অথচ আজকে যাদের হাতে দুই হাজার শহিদের রক্তের দাগ, তারা জেল থেকে বের হলে মনে হয়, শ্বশুরবাড়িতে পিকনিক করতে এসেছেন। আমরা খবর পেয়েছি ক্যান্টনমেন্টগুলোতে, জেলখানায় ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করা হয়।
তিনি বলেন, অনেক রাজনৈতিক দল ক্ষমতার লোভে আওয়ামী লীগকে মাফ করে দেওয়ার আলাপ তুলেছে। আপনার যদি মনে করেন শহিদের রক্তের ওপর দিয়ে সংসদে যাবেন, তাহলে আপনারা জাতীয় বেইমান হিসাবে স্বীকৃত হবেন।
সারজিস আলম বলেন, গত ১৬ বছর শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে শুধু টিস্যুর মতো ব্যবহার করেছেন। এখনো যদি কেউ আপনাদের পোশাক ব্যবহার করে তাহলে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। ভারতের এজেন্ট বা দালালদের কোনো চেষ্টা যেন সফল না হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্ক আর হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, মৌলবাদীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ট্যাগ লাগিয়ে হাজার হাজার মানুষকে গুম-খুন করা হয়েছে। সেই সময়ে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই চুপ ছিলেন। পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি হোক, যেন আর কোনো মানুষ গুমের শিকার না হন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আকতার হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে টর্চার সেল বানিয়েছে। ছাত্রলীগের বিচার করতে হবে। কারাগারে থাকা বিডিআর বিদ্রোহের মামলার নিরপরাধ মানুষের মুক্তি দাবি করেন।
সামান্তা শারমিন বলেন, জুলাইয়ের ঘটনায় শহিদ ও আহত হওয়ার পেছনে যাদের হাত আছে সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে।
নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বাংলাদেশে শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের আর পুনর্বাসন হবে না। শেখ হাসিনার? বিচারের আগে নাগরিক পরিষদের পক্ষ থেকে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে অনেকে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। গুমের শিকাররা ফিরে এসেও কোনো কথা বলেননি। আয়নাঘরের নামে মানুষকে মাত্র সোয়া তিন ফিট জায়গার মধ্যে দিনের পর দিন বন্দি করে রাখা হয়েছে। সেই বদ্ধ কুঠরিতে গিয়ে দেখা গেছে, ‘আই লাভ মাই কান্ট্রি, আই লাভ মাই ফ্যামিলি, এমনকি সেখানে কুরআন শরিফের সুরাও লেখা আছে। গুম তদন্ত কমিশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে।
ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সবাইকে বুঝতে হবে। আজকে যদি সংস্কার করা হয়, সেটি কাল আবারও পুনরায় সংস্কার করতে হতে পারে।
গণজমায়েতে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, মাহমুদুর রহমান মান্না, হেফাজত নেতা মুফতি মনির হোসেন কাসেমী, গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকি, জামায়াতের এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, সালাউদ্দিন কাদেরের ছেলে হুমাম কাদের, এবি পার্টির ফুয়াদ, অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস সাঈদ আব্দুল্লাহ বক্তব্য দেন।