মানবিজ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা
দামেস্কে বিমান হামলা ইসরাইলের ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে যে বার্তা দিলেন সিরিয়ার আল-জোলানি সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ বরদাশত করবে না তুরস্ক : এরদোগান
মার্কিন সমর্থিত কুর্দি সিরিয়ান বাহিনী (এসডিএফ) নিরাপদ প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার পর তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহীরা সিরিয়ার উত্তরের শহর মানবিজে অগ্রসর হয়েছে। সোমবার সিরিয়ার একটি বিরোধী সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ার বিরোধী দলগুলো এর আগে এসডিএফ থেকে মানবিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল, একটি তুর্কি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে, দামেস্কের দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাচ্যুত করার একদিন পর মানবিজও তারা মুক্ত করতে সক্ষম হল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়্যেপ এরদোগান, আনাকরাতে আলাদাভাবে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে, তিনি মানবিজ থেকে ‘সন্ত্রাসীদের’ নির্মূলকে স্বাগত জানিয়েছেন, যেটি সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ) এবং অন্যান্য তুরস্ক-সমর্থিত গোষ্ঠীর সাথে লড়াইয়ের মধ্যে সাম্প্রতিক দিনগুলিতে এসডিএফ ধরে রেখেছিল।
কুর্দি যোদ্ধারা ‘শহর থেকে প্রত্যাহার করেছে এবং এখন তাদের অন্যান্য এলাকাও থেকে প্রত্যাহার করতে হবে’ মানবিজের পূর্বে, বিষয়টির সাথে পরিচিত সিরিয়ার বিরোধী সূত্র জানিয়েছে।
এসডিএফ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মার্কিন জোটের প্রধান মিত্র। তুরস্ক বলেছে যে, এটি একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছে যারা নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) জঙ্গিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যারা ৪০ বছর ধরে তুর্কি রাষ্ট্রের সাথে লড়াই করেছে। রয়টার্স দ্বারা যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তুর্কি সীমান্তের প্রায় ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) দক্ষিণে এবং ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিমে অবস্থিত মানবিজের বাসিন্দারা বিরোধী বাহিনীকে স্বাগত জানাচ্ছে।
এদিকে, বিদ্রোহীদের তড়িৎগতির আক্রমণের মুখে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার সরকারের পতনের পর দেশটিতে বিমান হামলা বৃদ্ধি করেছে ইসরাইল। এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একাধিক ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এদিকে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামরিক ট্যাংক দামেস্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলেও সিরিয়ার একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
আসাদের পতনের পর সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অস্ত্র যাতে অন্য কোনও শত্রুর হাতে না যায়, সেই লক্ষ্যে ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল। তবে সিরিয়ার সাথে সীমান্ত এলাকার নির্ধারিত বাফার জোনের বাইরে সিরীয় ভূখণ্ডে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রবেশের খবর অস্বীকার করেছে তেল আবিব। গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) বাশার আল-আসাদের পতনের পর মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে মঙ্গলবার সিরিয়ার রাজধানীতে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংক পুনরায় খুলে দেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দামেস্কের রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন কর্মীরা। কিছু রাস্তায় যানবাহনের চলাচল বেড়েছে। দোকান পাট পুনরায় খুলতে শুরু করেছে। নির্মাণ শ্রমিকরা শহরের কেন্দ্রস্থলের গোলচত্বর মেরামত করছেন।
মঙ্গলবার অন্তত তিনটি নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, ইসরাইলি সৈন্যরা বাফার জোন অতিক্রম করেছে। সিরীয় একটি সূত্র বলেছে, ইসরাইলি সৈন্যরা ইতোমধ্যে কাতানা শহরে পৌঁছেছে। এই শহরটি বাফার জোন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বে ও দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত। যদিও ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, সেনারা ডিমিলিটারাইজড জোনের (ডিএসজেড) বাইরে যায়নি। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এক কর্মকর্তা বলেছেন, দামেস্ক অভিমুখে ইসরাইলি ট্যাংকের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সব প্রতিবেদন মিথ্যা। আইডিএফের সৈন্যরা বাফার জোনে অবস্থান করছে। সিরিয়ায় ইসরাইলি বাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং হামলার নিন্দা জানিয়েছে মিসর, কাতার ও সউদী আরব। রিয়াদ বলেছে, ইসরাইলের এমন পদক্ষেপ সিরিয়ায় নিরাপত্তা ফেরানোর সম্ভাবনাকে নষ্ট করবে।
ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে যে বার্তা দিলেন সিরিয়ার আল-জোলানি : দুই দশক আগে ছিলেন আল-কায়েদার যোদ্ধা। এখন তিনি সিরিয়ার বিদ্রোহী দলের নেতা। তার হাত ধরেই পতন হয়েছে বাশার আল-আসাদের ইস্পাত কঠিন শাসন। তিনি আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করার পর সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বিজয় বার্তা দিয়েছেন এই বিজয়ী নেতা। বিশ্লেষকদের মতে, তার এই বক্তব্যে লুকিয়ে আছে অন্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সোমবার মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন’র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে আল-গোলানির বিজয়-বার্তা।
কোনো টিভি স্টেশন নয়, অথবা সদ্য খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ বা কোনো মঞ্চও নয়, রাজধানী দামেস্কের ঐতিহ্যবাহী উমাইয়াদ মসজিদে বসে তিনি বিজয় বার্তা দিয়েছেন। যারা আল-জোলানিকে শক্তিশালী করে তুলেছেন তাদের কথাই এই বার্তায় উল্লেখ করেন তিনি। ঝটিকা অভিযান চালিয়ে তার সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধারা কীভাবে বাশার আল আসাদকে উৎখাত করল সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেন তিনি। পাশাপাশি অন্যদের দিয়েছেন সুনির্দিষ্ট বার্তা।
তিনি বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, যারা দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন, অনেক দুর্ভোগ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই বিজয় এসেছে।’ বিশ্লেষকদের মতে, বিজয়বার্তার মাধ্যমে দেশটিতে ধর্ম-পরিচয় সূত্রে বিভেদ-বিভাজন দূর করার ইঙ্গিত দিয়েছেন আল-জোলানি। আল-জোলানি নিজে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি সম্প্রদায়ের সদস্য। অপরদিকে, আসাদ ছিলেন আলাওয়াত সম্প্রদায়ের। দেশটিতে খ্রিষ্টান, দ্রুজ, শিয়া, ইসমাইলীসহ আরও অনেক ধর্মাবলম্বী আছেন। আল-জোলানি বলেন, ‘এই বিজয়ে এ অঞ্চলের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এই অঞ্চলের ইতিহাস ছিল অনেক বিপদের ঘটনা ও উৎস, যা আজ সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এতদিন সিরিয়া ছিল ইরানের নানা অভিলাষ পূরণ, গোত্রে গোত্রে সংঘাত ও দুর্নীতি ছড়ানোর ক্রীড়াক্ষেত্র।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইরানের ক্ষমতাসীনদের স্পষ্ট বার্তা দেন। সিরিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তেহরানের নাক গলানো আর বরদাশত করবেন না আল-জোলানিÑবিষয়টি এখন নিশ্চিত। পাশাপাশি, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহকে সিরীয় ভূখণ্ডে অবাধ প্রবেশাধিকার ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর শাখার প্রতি সমর্থন বন্ধেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও, ইরানের ‘অস্ত্রের গুদাম’ হিসেবে সিরিয়ার পরিচয়ও মুছে দেয়ারও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
আল-গোলানি জানতেন, তার এই বিজয়বার্তা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওয়াশিংটন ও তেল আবিব। ‘জঙ্গি সংগঠনের’ নেতা হিসেবে তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য এই দুই দেশ ইতোমধ্যে এক কোটি ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বীকার করছি, নতুন সিরিয়ার সঙ্গে আপনাদের স্বার্থ জড়িত।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে তাকেও সরিয়ে দেয়া হতে পারে, এ কথা মাথায় রেখেই এই বক্তব্য দিয়েছেন সিরিয়ার নতুন নেতা। তার বক্তব্যে এই অঞ্চলের অন্যান্য ক্ষমতাবানদের প্রতিও বার্তা আছে। ‘সিরিয়াকে পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে,’ বলেও দাবি করেন তিনি।
সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদ বরদাস্ত করবে না তুরস্ক : তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডের প্রতি তাদের কোনো দাবি নেই, তবে সে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি সহ্য করবে না, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন।
‘সিরিয়ার সংঘাতের প্রথম থেকেই তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইন কঠোরভাবে পালন করে আসছে। আমরা সিরিয়ায় স্বাধীনতা, সংলাপ, ন্যায়বিচার ও শান্তির পক্ষে রয়েছি। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বৈরী মনোভাব থাকা সত্ত্বেও আমরা সমর্থন দিয়ে আসছি। সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং একত্বের নীতি আমরা সমর্থন দেই। সিরিয়ার কোন আঞ্চলিক দাবি নেই কিন্তু আমরা সেখানে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির অস্ত্রের কার্যকলাপ সহ্য করব না। আমরা তাদের উপর কড়া নজর রাখছি,’ তিনি একটি সরকারি বৈঠকের পর বলেন। ‘সংলাপের মাধ্যমে সিরিয়ার সংঘাত সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্য (সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদ) সরকারের প্রতি তুরস্কের আহ্বান প্রাক্তন সরকার অহংকারে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যা তুরস্কের সাহায্যের হাত ধরে রাখার জন্য উপেক্ষা দেখায়,’ তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
‘তুরস্ক অঞ্চলগুলিতে আগ্রহী নয় এবং একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে চাইছে না। আমাদের আন্তঃসীমান্ত অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য হল সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে আমাদের দেশ এবং জনগণকে রক্ষা করা। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (তুরস্কে নিষিদ্ধ) কিংবা ইসলামিক স্টেট (রাশিয়ায় নিষিদ্ধ) আমাদের দেশের জন্য সংলাপের অংশীদার নয়। বরং তারা আমাদের শত্রু। প্রতিবেশী এবং ভাই হিসেবে আমাদের কর্তব্য তাদের দেশকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সিরিয়ার জনগণের প্রচেষ্টাকে জোরালোভাবে সমর্থন করা,’ এরদোগান জোর দিয়ে বলেছিলেন। তুর্কি নেতার মতে, তার দেশ সিরিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তায় পৌঁছাতে কোনো প্রচেষ্টাই ছাড়বে না।