Hot

কর ফাঁকি অর্থ পাচারে নতুন কৌশল বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা অজানা

প্রকৃত বেতন গোপন করে কাজের অনুমোদন নেওয়া হয় * দেশে ২৭৪টি বিদেশি এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে

জার্মানিভিত্তিক এনজিও ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করছেন ভারতীয় নাগরিক পঙ্কজ কুমার। প্রতিমাসে বেতন পান সাড়ে ৭ হাজার ইউরো। অথচ আয়কর বিভাগে বেতন দেখিয়েছেন সাকুল্যে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা (দেড় হাজার ইউরো)। এর বিপরীতে উৎসে কর কর্তন দেন ২০ হাজার ১৪৬ টাকা। বেতনের বাকি টাকা নিজ দেশে স্থানান্তর করছেন। তিনি ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সুইস সোলজারস, সেফার ওয়ার্ল্ড এবং ক্রিস্টিয়ান এইডের মতো এনজিওতে কাজ করেছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

শুধু পঙ্কজ কুমার নন। বাংলাদেশে ২৭৪টি বিদেশি এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব এনজিওর কান্ট্রি হেড বা কান্ট্রি ডিরেক্টররা বিদেশি নাগরিক। এ ধরনের এনজিওগুলোর প্রধানরা প্রকৃত বেতন গোপন করে এনজিও ব্যুরো থেকে কাজের অনুমোদন নিয়েছেন। এনজিওগুলোয় কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের চেয়ে নির্বাহীরা কম বেতন ব্যাংকিং চ্যানেলে গ্রহণ করছেন এবং আয়কর বিভাগে প্রদর্শন করছেন। প্রকৃত বেতনের বড় অংশ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সব জেনেশুনেও নীরব এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও একই অবস্থা।

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো পঙ্কজ কুমারের নিয়োগ অনুমোদন দেয়। এতে ৫টি শর্ত দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বেতনভাতা নিতে হবে। তিনি বা তার পরিবারের অন্য সদস্য অপর কোনো সংস্থায় বেতনে/বিনা বেতনে চাকরি করতে পারবেন না। বাংলাদেশ ত্যাগের ৭ দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে জানাতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আয়কর দিতে হবে। একই সঙ্গে নিয়োগপত্রে যুক্তিযুক্তভাবে বেতনভাতা উল্লেখপূর্বক এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে সত্যায়ন নিতে হবে এবং হালনাগাদ আয়কর সনদপত্র ব্যুরোতে দাখিল করতে হবে।

বেতন গোপনের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ফিন্যান্স নিলিমা জাহান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিমাসে বেতন হিসাবে পঙ্কজ কুমারের যেই অর্থ আসে, তার ওপর এনবিআর-এর নির্ধারিত হারে উৎসে কর কর্তন করা হয়। এখানে আয়কর আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে না। অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিমাসে সুযোগ-সুবিধা ব্যতীত পঙ্কজ ৮ হাজার ৭৫০ ইউরো বেতন পান। এর ছোট একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে, বাকিটা ভারতে স্থানান্তর করেন। তিনি বাংলাদেশে মধ্যম মানের (মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টে কর্মরত) কর্মীর চেয়েও কম বেতন দেখাচ্ছেন আয়কর বিভাগে।

এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য পঙ্কজ কুমারের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়েও জবাব মেলেনি। তার প্রকৃত বেতনের দলিলাদি যুগান্তরের কাছে রক্ষিত আছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিয়েই বিদেশিরা অর্থ পাচার করছে এবং কর ফাঁকি দিচ্ছে। কারণ, নিয়োগের সময় তাদের বেতন কম দেখানো হয়। কর্মরত ব্যক্তি বাংলাদেশে শুধু খরপোষ ভাতা বা জীবননির্বাহের খরচ গ্রহণ করছেন-এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করে অনুমোদন নেওয়া হয়। আর যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেটি মেনে নেয় ব্যুরো। এ কারণে বাংলাদেশে কর্মরত থেকেও বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশে অর্থ না এনে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি এনজিওগুলো নিজস্ব অনুদানে বাংলাদেশে পরিচালিত হয়। প্রতিটি এনজিওকে কান্ট্রি ডিরেক্টর বা কান্ট্রি হেডের মতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার আগে স্থানীয় বেতনভাতা উল্লেখ করে অনুমোদন নিতে হয়। যা ওই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক বেতনভাতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে এনজিও ব্যুরোতে ঘোষিত বেতনের ওপর আয়কর দিচ্ছে কি না সেটাই বিবেচ্য। যদি আয়কর বিভাগে ব্যুরোতে ঘোষিত বেতনের চেয়ে কম বেতন দেখান, তবে আয়কর ফাঁকি হতে পারে। এনজিওগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন কত হতে পারে, এর একটি মানদণ্ড আছে বলে জানান তিনি।

শুধু এনজিওকর্মীরাই নন, বেসরকারি খাতে কর্মরত বিদেশিরাও একই কায়দায় কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার করছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে চীনভিত্তিক একটি কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে অর্থ পাচারের প্রমাণ পায় পুলিশের বিশেষ ব্রাঞ্চ। পুলিশের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, চীনের এক নাগরিক ইনভেস্টর ভিসায় বাংলাদেশে এসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন। ওয়ার্ক পারমিটে তার বেতন দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। আরেক ব্যক্তি টেকনিশিয়ান ভিসায় বাংলাদেশে এসে লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওয়ার্ক পারমিটে তার বেতন দেখানো হয়েছে মাত্র ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ উভয় পদেই সমশ্রেণির প্রতিষ্ঠানে একজন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশি টাকায় ৪-৫ লাখ টাকা বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করেন।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, বিদেশি কর্মীদের বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বর্তমানে বিমানবন্দরে আয়কর সনদ যাচাই করা হয়। প্রক্রিয়াটি অটোমেশন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া কোনো বিদেশির কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেলে এনবিআর সেটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খতিয়ে দেখবে।

কর্মরত বিদেশিদের সঠিক তথ্য নেই সরকারি দপ্তরগুলোয় : বিদেশিদের বাংলাদেশে কাজ করার অনুমতি দেয় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এছাড়াও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) বিদেশিদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাধারণত বিদেশিদের হয়ে তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিয়ে থাকে। কত বিদেশি বাংলাদেশে কর্মরত আছেন, এর সঠিক তথ্য সরকারি সংস্থালোয় পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে কত বিদেশি কর্মরত আছেন বা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন, এর হালনাগাদ তথ্য এনবিআর ও সরকারি দপ্তরগুলোয় নেই। এনবিআর-এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ৪ হাজার ৫৬৫ জন বিদেশি করদাতা হিসাবে নিবন্ধিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত আছে কর অঞ্চল-১১তে, ৩৭ হাজার ৬৭৭ জন। এর পরের অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-২। বিদেশির কর অঞ্চল-১১তে নিবন্ধন নেওয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিবছর কত বিদেশি ওয়ার্ক পারমিট চেয়ে বাংলাদেশে আবেদন করেছেন, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) তার তথ্য প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সময় দেশে কাজের অনুমোদন পাওয়া বিদেশির সংখ্যা ২০-২২ হাজারের কাছাকাছি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৩০৩ জনকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ জনকে এবং ২০২০-২১-এ ৮ হাজার ৭৬ জন বিদেশিকে ওয়ার্ক পারমিট দিয়েছে সংস্থাটি।

অন্যদিকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, চাকরি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ৬ হাজার ৮২৭ এবং ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক ১১ হাজার ৪০৪ জন। এছাড়া শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৪৪টি দেশের নাগরিক কাজ করছেন। তারা তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়াশিল্প, চিকিৎসা সেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কাজ করছে। ৮ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের অনুরোধ জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, অনেক ভিনদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করছেন বা কর্মরত আছেন, তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button