ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে তাদের প্রথম মানচিত্র তৈরি করে ভারতবর্ষে ভূমি জরিপ করে
মানচিত্র তৈরিতে উইলিয়াম ল্যাম্বটনের পরিকল্পনা একরকম উন্মাদনাই ছিল। বহু বছর পর এবং কয়েক দফা সংশোধন করতে হয়েছিল, তবে ল্যাম্বটনের ধারণাতেই ভারতবর্ষের প্রথম ভূমি জরিপ হয়। ইউরোপীয়দের জন্য পৃথক সার্ভে স্কুলও ছিল মাদ্রাজে। রাজস্ব আদায়ে মানচিত্র ব্যবহার করতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
থমাস জেফেরি ও জেমস রেনেলির তৈরি মানচিত্র।
জেমস রেনেল ছিলেন বাংলায় কর্মরত প্রথম মানচিত্র তৈরিকারকদের একজন। তবে প্রথম ত্রিকোণমিতিক ভূমি জরিপের শুরু মূলত মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই), উইলিয়াম ল্যাম্বটনের নেতৃত্বে। যুক্তরাজ্যের মর্যাদাবান গ্রামার স্কুলের সাবেক এই শিক্ষার্থীকে ১৭৯৬ সালে ভারতবর্ষে নিয়োগ দেওয়া হয়।
দুই বছর পর কর্নেল আর্থার ওয়েলসলির সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। পরবর্তীতে ওয়েলিংটনের ডিউক হওয়া ওয়েলসলির মাদ্রাজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয় ল্যাম্বটনের। তারা দুজনই শেষ অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধে অংশ নেন এবং এতে টিপু সুলতানের মৃত্যু হয়।
টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর রাজস্ব সংগ্রহের মতো আরো জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আসে। কোম্পানি তখন ভূসংস্থান মানচিত্র তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল কলিন ম্যাকেঞ্জিকে সার্ভেয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তবে মানচিত্র তৈরিতে ল্যাম্বটনের প্রস্তাব ছিল আরো বেশি তাত্ত্বিক ও প্রয়োগযোগ্য। উত্তর অক্ষাংশে পৃথিবীর বক্রতা প্রতিষ্ঠায় ফ্রান্স ও স্পেনে ততদিনে ভূমি জরিপ হয়েছিল এবং ল্যাম্বটন ভারতে জরিপটি প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন।
তিনি এই কাজটি করতে দক্ষিণে কেপ কমোরিন থেকে হিমালয়ের দেরাদুন পর্যন্ত সরল রেখায় ত্রিভুজাকৃতির একটি বিশাল গ্রিড তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যাকে গ্রেট মেরিডিওনাল আর্ক বলা হয়। আর ল্যাম্বটনের জরিপ প্রচেষ্টাকে বলা হয়, গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সার্ভে (জিটিএস)।
বিজ্ঞানমনস্ক নয় এমন ব্যক্তিদের কাছে এই পরিকল্পনা পাগলামি বলে মনে হয়েছিল। কিছু মাত্রায় এটি উন্মাদনাই ছিল। ১৮৭০ সালে, ল্যাম্বটনের মৃত্যুর (১৮২৩ সাল) বহু বছর পর এই জরিপ সম্পন্ন হয়। ভুল থাকায় ত্রিভুজটির বেশিরভাগ অংশই পুনরায় জরিপ করতে হয়েছিল। কয়েকবারই ভুলভাবে কাজ শুরু হয়। জরিপ শুরু হয় চীনের সম্রাটকে উপহার হিসেবে দেওয়ার লক্ষ্যে কেনা পূর্বে ব্যবহার হওয়ার সরঞ্জাম দিয়ে। তবে জরিপের চেষ্টা দেখায় যে, সবকিছু পরিমাপ করা, শ্রেণিকরণ করা, গণনা করা এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
জিটিএসকে একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হিসাবে দেখা যেতে পারে, যদিও ল্যাম্বটন ভৌগোলিক সমন্বয় স্থাপনে মানচিত্রের ব্যবহারিক মূল্যের উপর জোর দিয়েছিলেন। এশিয়াটিক রিসার্চেস-এর একাধিক প্রবন্ধে তিনি ত্রিকোণমিতিকভাবে ‘ভারতের উপদ্বীপ অতিক্রম করে’, ফোর্ট সেন্ট জর্জকে ম্যাঙ্গালোরের সাথে সংযুক্ত করার (তিনি ৩৬২ মাইল দূরত্ব গণনা করেছিলেন) এবং করদান্দেল ও মালাবার উপকূলের কিছু অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য তার অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেছেন। কাজের পরিধি বাড়িয়ে দুই সমুদ্রকে যুক্ত করতে দেশের সমস্ত প্রধান শহরগুলির অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশগুলিকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যও ছিল তার।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তিনি তার গণনার তালিকা লিখে গেছেন। স্থানগুলোর নাম তিন ভাগে বিভক্ত করে লেখেন। যেখানে ত্রিভুজ আকৃতি হতো সেখানে পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করেন। ল্যাম্বটন ‘সাধারণ পাঠক’ এর জন্য তার পাওয়া তথ্যগুলোর সংক্ষিপ্তসার করেছেন। কারণ তারা হয়তো বিস্তারিতভাবে তথ্যগুলো দেখার আগ্রহ পাবে না। তবে বাস্তবতা হলো খুব কম লোকই তার এমন জটিল গণনা পদ্ধতি বুঝতে পেরেছিলেন। তারপরও ভারতীয় উপদ্বীপের একটি ছোট অংশ জরিপ করা এবং তা মুদ্রিত পৃষ্ঠায় রূপান্তরের ধারণাটি ছিল আকর্ষণীয়।
ল্যাম্বটনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান তার সাবেক সহকারী এবং উত্তরসূরি জর্জ এভারেস্ট। তিনি উলউইচ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং ক্যাডেট হিসেবে ভারতে আসেন। পরবর্তীতে তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও বাংলায় বেশ কয়েকটি জরিপ চালান। চিকিৎসার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং পরে ফিরে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন সঠিক পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম। পরিমাপের ধাতব এসব যন্ত্র সম্প্রসারণ ও সংকোচন করা যেত।
জিটিএস-এর সময় তৈরি করা চার্ট ও মানচিত্র ছাড়াও ভূমি জরিপের দুটি দৃশ্যমান প্রমাণ রয়েছে। কলকাতা থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত রাস্তায় দুটি সার্ভে টাওয়ার এখনো বিদ্যমান। এলাকাটি উল্লেখযোগ্যভাবে সমতল হওয়ায় পরিমাপ শুরু করার জন্য একটি বেসলাইন স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। তাই ৭৫ ফুট উঁচু টাওয়ারগুলি তৈরি করা হয়েছিল এবং সেগুলোর ছাদ থেকে পর্যবেক্ষণ নেওয়া হয়েছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারি হাইড্রোগ্রাফার জন থর্নটনের তৈরি গঙ্গা নদীর মানচিত্র।
এছাড়া ১৭৯৪ সালে অনাথ ইউরোপীয় ছেলেদের জন্য একটি সার্ভে স্কুল খোলা হয়েছিল। ১৬ বছর এই স্কুল চালু ছিল। এসব কিশোরদেরকে কর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভূমি জরিপের ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখানো হতো। ল্যাম্বটনের জরিপ থেকে তাদের কাজ ভিন্ন হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন করে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এলাকাগুলোর প্রশাসনিক কাজের জন্য কোম্পানি করের ওপরই নির্ভর করতো।
কলিন ম্যাকেঞ্জির মহীশূরের টপোগ্রাফিক জরিপে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উর্বর জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে; কিভাবে এটি সেচ করা হয়েছিল; কোন এলাকায় কলা, নারকেল গাছ বেশি ছিল; আর জঙ্গল এলাকা কতটুকু ছিল সবকিছু মানচিত্রে চিহ্নিত ছিল। এই সবগুলিই রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক বিষয় ছিল।
সার্ভে স্কুলের ছাত্ররা নিজেরা রাজস্ব সংগ্রহ করেনি। সশস্ত্র সিপাহিদের সাথে স্থানীয় লোকদের পাঠিয়ে কর নেওয়া হতো। জরিপ স্কুল শুধুমাত্র ইউরোপীয়দের জন্য উন্মুক্ত ছিল, ভারতীয়দের ভর্তি করা হয়নি। এদিকে কোম্পানির মধ্যে প্রচার হয়ে যায় যে, জরিপকারীরা ঘুষের মাধ্যমে ধনীদের জমির আকার ছোট আর দরিদ্রদের বড় দেখিয়ে জরিপ হয়েছে (ইউরোপীয় নাকি স্থানীয়; কারা ঘুষ নিয়েছে তা বইতে স্পষ্ট করা হয়নি)। সার্ভে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৮১৩ সালে স্থানীয় সহায়তাকারীদেরকেও জরিপের কাজে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ স্থানীয়রা জরিপের কাজ শিখবে এই বিষয়ে কোম্পানি উদ্বিগ্ন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত স্থানীয়দের বাদ দিয়ে সেই এলাকার জরিপ পরিচালনা অযৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়। তবে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার পর কোম্পানি আরেক চাপে পড়ে। কোম্পানির কর্মকর্তাদের তখন জমির মালিকানা ও ভাড়া দেওয়ার জটিল ধরন ও মুঘল আমলে বিকশিত হওয়া জায়গির প্রথার সাথে পরিচিত হতে হয়েছিল।