দুর্জয়কে গুলি করে মেরে পানিতে ফেলে পুলিশ
আবু সাঈদের মতোই উত্তরায় বুক পেতে দাঁড়ান দুর্জয়
আন্দোলনের সময় উত্তরায় গুলিতে নিহত যুবকের লাশ দু’দিন পর টঙ্গীর একটি বিলে কীভাবে উদ্ধার হলো, তা জানতে গিয়ে পাওয়া গেছে লোমহর্ষক তথ্য। গত ১৮ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে এপিসিতে উঠে পড়া মোখলেছুর রহমান দুর্জয়কে অস্ত্রসজ্জিত এই যানে থাকা পুলিশ সদস্য গুলি করে। পড়ে যাওয়ার পর এপিসি তাঁর ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে হত্যা করার এমন দৃশ্য ছবি-ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এর দু’দিন পর ভোরে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশ গুদারাঘাটের মরকুন বিল থেকে ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে। পকেটে থাকা মোবাইল ফোনের সিম খুলে অন্য ফোনসেটে লাগিয়ে পরিবারকে জানায় পুলিশ।
মামলার এজাহারে দুর্জয়ের বাবা হাবিবুর রহমানের বরাতে লেখা হয়েছে, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অজ্ঞাতনামা আসামি বা আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে গত ১৬ জুলাই সন্ধ্যা থেকে ২০ জুলাই সকাল আনুমানিক ৭টার মধ্যবর্তী কোনো সময়ে আমার ছেলেকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য পানিতে ফেলে দেয়।’ তবে এ মামলা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেছেন, ‘২০ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আমি টঙ্গী পূর্ব থানায় যাই। কিন্তু ছেলের লাশ আনতে যখন গিয়েছিলাম থানায় আমাদের থেকে দুই-তিনটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে, কীসের কাগজ কীসের কী, তা জানি না। আমি কোনো মামলা করিনি।’
টঙ্গী পূর্ব থানায় ২০ জুলাই ৩৮ নম্বর মামলার এজাহারে বাদী হিসেবে মোখলেছুরের বাবা হাবিবুর রহমান, বোনের স্বামী মো. সাইফুল ইসলাম খান ও চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলীর নাম রয়েছে। মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী এসআই উৎপল কুমার বলেন, মোখলেছুরের বাবা এবং সেদিন লাশ নিতে আসা আরও দুই স্বজন বাদী হয়ে মামলা করেছেন।
মোখলেছুরের লাশের ময়নাতদন্ত হয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখান থেকে লাশ নিয়ে জামালপুরের সরিষাবাড়ীর হিরণ্যবাড়ী গ্রামে নিজ বাড়িতে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। তাঁর মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন টঙ্গী পূর্ব থানার এসআই মিজানুর রহমান। তিনি বদলি হয়ে গেলে এসআই উৎপল কুমার মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি জানান, তদন্তে তেমন অগ্রগতি নেই। জব্দ তালিকায় একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন রয়েছে। সেটি অকেজো। ঘড়ি, মানিব্যাগ স্মৃতি হিসেবে নিতে চাইলে সে সময়ই তাঁর বাবাকে দেওয়া হয়েছিল। মোখলেছুর উত্তরা পূর্ব থানার সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত যুবক কিনা– এ প্রশ্নে এসআই উৎপল বলেন, এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত বিরোধে কেউ হত্যা করে লাশ ফেলে যেতে পারে বলে মামলার এজাহারে তাঁর বাবা উল্লেখ করেছেন।
মোখলেছুরকে গুলি করে হত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যের পরিচয় পাওয়া যায়নি। সে সময় ওই থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন মুজিবুর রহমান। গত ২ আগস্ট তাঁকে বদলি করা হয়। এর পরও একাধিকবার বদলি হয়েছেন। তবে এখন কোথায় আছেন, তা জানা যায়নি। উত্তরা পূর্ব থানার বর্তমান ওসি মহিবুল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে গত মঙ্গলবার থানায় গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে একাধিকবার ফোন করেও তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে মঙ্গলবার এএসআই মাহমুদ হাসান এ ঘটনা শুনে তালিকা দেখে জানালেন, এমন নামে কোনো মামলা নেই তাদের থানায়। উত্তরা থানায় অগ্নিসংযোগ করায় ৫ আগস্টের আগের কোনো কিছুই নেই বলেও জানান মাহমুদ।
প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য
উত্তরায় আন্দোলনকালে হতাহতদের তথ্য সংগ্রহ, তালিকা তৈরি ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে কাজ করছে নবগঠিত সংগঠন ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’। সংগঠনটির আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান ১৮ জুলাই বিকেলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘তখন তো জানতাম না উনি মোখলেছুর রহমান। বারবার পুলিশের সামনে দুই হাত মেলে দাঁড়াচ্ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে এপিসিতে উঠে থানার দিকে ফিরে বুক পেতে দাঁড়ালেন মোখলেছুর। এপিসির ভেতরে পুলিশ ছিল এটি মোখলেছুর খেয়াল করেননি। পুলিশ মাথা বের করে গুলি করলে তিনি নিচে পড়ে যান। হামাগুড়ি দিয়ে এপিসির পেছনে চলে যান। উঠে বসার চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় এপিসি পেছনে যেতে থাকলে লোকজন চিৎকার করে বলে মানুষ আছে, মানুষ আছে। ততক্ষণে এপিসির চাকা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে যায়। এ সময় তাঁর মগজও বের হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল।’
উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে ১৬ নম্বর সড়কে একটি বাড়ির ছয় তলায় মেসে থাকতেন মোখলেছুর। তাঁর সঙ্গে থাকতেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাহমুদুল হাসান পল্লব। তিনিও টঙ্গী পূর্ব থানার উদ্ধার করা লাশের ছবি-ভিডিও দেখে চিনতে পেরেছেন– এটিই মোখলেছুর রহমান দুর্জয়। তিনি বলেছেন, মোখলেছুর আকাশি রঙের শার্ট, সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, কালো বেল্ট ও কালো জুতা পরে সেদিন বের হয়েছিলেন।
শহীদের তালিকায় নাম উঠল যেভাবে
মোখলেছুরের লাশ উদ্ধার হলো টঙ্গীতে বিল থেকে। তাহলে গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের তৈরি সরকারি শহীদের তালিকায় নাম উঠল কীভাবে– সে প্রশ্ন উঠেছে। সরিষাবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অরুণ কৃষ্ণ পাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের তালিকা তৈরিতে দেশের অন্যান্য উপজেলার মতো সরিষাবাড়ীতেও কমিটি করা হয়। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু’জন প্রতিনিধিও রয়েছেন। সবার সুপারিশের ভিত্তিতে শহীদের তালিকায় মোখলেছুর রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কী করতেন মোখলেছুর
মোখলেছুরের পকেটে থাকা মানিব্যাগে কনক্রিট ডেভেলপারস লিমিটেডের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদবির একটি ভিজিটিং কার্ড পাওয়া গেছে। কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, মোখলেছুর তাদের ফ্ল্যাট বিক্রিতে কমিশন ভিত্তিতে কাজ করতেন। কনক্রিট ডেভেলপারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নূর কুতুবুল আলম জীবন সমকালকে বলেন, ‘১৪ জুলাই সর্বশেষ মোখলেছুরের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি ফ্ল্যাট বিক্রি করতেন, মাঝেমধ্যেই ক্লায়েন্ট নিয়ে আমাদের প্রজেক্টগুলোতে যেতেন। অত্যন্ত মার্জিত এবং খুব ভদ্র ছিলেন। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতেন না।’
মোখলেছুর ছিলেন প্রতিবাদী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা’ কবিতার আদলে কবিতা লিখে তা রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করা ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। মোখলেছুরের আট লাইনের কবিতার প্রথম চারটি লাইন এমন– বিদ্রোহের দামামা বেজেছে আজ, আরও আরও বাজুক;/রক্ত দিয়ে বুলেট কিনব, এগিয়ে দিয়েছি বুক। মনে রাখিস, পরাজয়ের সাথে আমার আজন্ম আড়ি;/আমার মৃত্যু মানেই তোর দাফন, তোদের দাফন সারি সারি।’
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে ১৬ জুলাই পুলিশের গুলির সামনে আবু সাঈদ যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই দুই হাত প্রসারিত করে উত্তরায় দাঁড়িয়েছিলেন মোখলেছুর। নীরব ও সাদামাটা জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন তিনি। তাঁর বাবা হাবিবুর বলছিলেন, ‘গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ কী করত, বলত না তেমন একটা। কবিতা-টবিতা লিখত। একটু নিজের মতো করে থাকত।’ নিজের ফেসবুক বায়োতে মোখলেছুর লিখে রেখে গেছেন, ‘হারানোর বিজ্ঞপ্তি দিও না। কারণ, লুকিয়ে থাকাকে হারিয়ে যাওয়া বলে না।’