Hot

শীতবস্ত্রের অভাবে লাখ লাখ মানুষ অসহায়

শীতে কাঁপছে দেশ। কিন্তু হতদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের কাপড় নেই। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে গরিব মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক কম কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে কম্বলের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের জন্য জ্যাকেট/সোয়েটার বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে শীতার্ত দুস্থ মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ৩৩ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং ১৫ হাজার ২৫০ পিস কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গড়ে জনপ্রতি বরাদ্দ ১১.৮১ টাকা। অল্প পরিমাণ কম্বল বিতরণ করা নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।

এদিকে শুধু কম্বলে শীত মানছে না দরিদ্র মানুষের। কম্বল বরাদ্দ থাকলেও ঘরের বাইরে যেতে যে শীতবস্ত্রের (জ্যাকেট/সোয়েটার) প্রয়োজন, তা নেই। শীতে কর্মহীন মানুষের জন্যও নেই মানবিক সহায়তা। রাজনৈতিক দলগুলো নেই শীতার্ত মানুষের পাশে। সরকারিভাবে যে অল্প শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে, তাও শহরের আশপাশে। দুর্গম এলাকায় যাচ্ছে না কম্বল। এমন পরিস্থিতিতে শীতপ্রবণ এলাকার লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে শুধু কম্বল দিয়ে দায় শেষ করা যাবে না। শ্রমজীবীরা সারাদিন বাইরে কাজ করেন। ফলে তাদের কাজের উপযোগী শীতবস্ত্র দিতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কর্মসূচি চালু করতে পারে। শীত নিবারণে সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ জরুরি। বছরে প্রায় চার মাস বৃহৎ জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন কাটায়। সে জন্য অনিবার্য এই শীত থেকে রক্ষা পেতে সরকারি উদ্যোগ থাকা জরুরি। প্রয়োজনে সরকার অসহায় শীতার্ত মানুষের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।

অপ্রতুল সহায়তা

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাসহ ৬৪ জেলায় প্রায় তিন কোটি দরিদ্র মানুষের শীতবস্ত্রসহ মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, এ দেশে শীতকালে দরিদ্র বেড়ে যায়। জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে ২৭ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ বাস করে, যা সংখ্যায় ৩ কোটি ৯৩ লাখ। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে আরও প্রায় ৪৫ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। ওই সময়ে গ্রাম এলাকায় প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনের বেশি গরিব হয়ে যায়।

২০২০ সালে বিবিএস এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথভাবে প্রকাশ করা বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে (পোভার্টি ম্যাপস অব বাংলাদেশ) দেখা যায়, দিনাজপুরে ৬৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, যা সংখ্যায় প্রায় সাড়ে ২১ লাখ। আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব বলছে, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের এই জেলায় আট দিন শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। এই জেলায় চলতি শীত মৌসুমে সরকার বরাদ্দ করেছে ৩৯ লাখ টাকা ও তিন হাজার পিস কম্বল।

রংপুর অঞ্চলে শীত মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ বলতে শুধু কম্বল হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সে কারণে হতদরিদ্রসহ নদীপাড়ের মানুষ পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। রংপুরে প্রায় তিন লাখ হতদরিদ্র মানুষ আছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন জানান, প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় আরও কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এবার দুই দফায় মোট ১৬ হাজার ৬০০ কম্বল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রাপ্ত ৫৪ লাখ টাকায় ২৮ হাজার ৩৭২টি কম্বল কিনে বিতরণ করা হয়েছে।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রমজান আলী জানান, সরকারি বরাদ্দের আটটি কম্বল পেয়েছেন। এগুলো এলাকার আটজন বয়স্ক মানুষকে দিয়েছেন। তাঁর এলাকায় প্রায় ৫০০ পরিবারের কম্বল কেনার সামর্থ্য নেই। গঙ্গাচড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সজিবুল করিম জানান, শীত মোকাবিলায় ১ হাজার ৮৫০টি কম্বল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রাপ্ত সাড়ে ৫ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে আরও ১ হাজার ১৯৮টি কম্বল। এগুলো ৯টি ইউনিয়নে ১৫০টি করে এবং এতিমখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে।

ঝিনাইদহ জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ছয়টি উপজেলায় জনসংখ্যা ২০ লাখ ৫ হাজার ৮৪৯ জন। এর মধ্যে অতিদরিদ্র এবং দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১৮.৭ ভাগ আর বেকার ৩.৬ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিম্নমধ্যবিত্ত ও রোজগারের অভাব মিলিয়ে কম্বলের চাহিদা প্রায় ৩০ ভাগ মানুষের। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিল থেকে পাওয়া এবং কেনা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ১৩৮ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। মজুত আছে ৩ হাজার ৯৬৪ পিস কম্বল।

খুলনা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখা থেকে জানা গেছে, চলতি বছর খুলনা জেলা ও নগরীর জন্য ২২ হাজার ৪০০ পিস কম্বল কিনে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা নগরীতে ২ হাজার ৮০০ পিস এবং ৯টি উপজেলায় ১৯ হাজার ৪০০ পিস। গত বছর ৫৫ হাজার ৫০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছিল।

মৌলভীবাজারে ৯২টি চা বাগান ও হাওর পাড়ের বেশির ভাগ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা। সাত উপজেলায় বিপুল সংখ্যক অভাবী পরিবারের মানুষ রয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৮১ পিস কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ হয়েছে ১২ হাজার ৫১৭ পিস। সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু মিয়া চৌধুরী বলেন, ‘হাজার হাজার শীতার্ত মানুষ কষ্ট করলেও বরাদ্দ পেয়েছি ৯৮ পিস।’ কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলি আহমদ খান বলেন, ‘৯টি ওয়ার্ডের জন্য মাত্র ৫০টি কম্বল পাওয়া গেছে।’

নওগাঁয় প্রতিবছর শীতের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য জেলার চেয়ে একটু বেশি অনুভূত হয়। জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ অফিস এবং জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, নওগাঁয় ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬১ জনসংখ্যার মধ্যে ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৩ জন গ্রামে এবং ৪ লাখ ১৬ হাজার ৭৭৮ জন শহরে বসবাস করেন। এসব জনসংখ্যার বিপরীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় তিন ধাপে কম্বল কেনার জন্য মোট ৬৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এই টাকায় স্থানীয়ভাবে ২১ হাজার ৩১৩ পিস কম্বল কেনা হয়। এগুলো জেলার ১১ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে এবং তিনটি পৌরসভায় প্রশাসকদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ঘোলপাশা ইউনিয়নে গ্রাম আছে ২৭টি। এ ইউনিয়নের জন্য শীত মোকাবিলায় প্রথম দফায় কম্বল বরাদ্দ মিলেছে ৩০টি। তাই প্রতি গ্রামে দেওয়া হয়েছে একটি করে।

কর্মহীন, মানবেতর জীবন

শীতে নিম্নবিত্ত মানুষ কী পরিমাণ কষ্টে আছে, তা পঞ্চগড়ের আকরাম হোসেনের কথায় বোঝা যায়। তিনি থাকেন পঞ্চগড় সদরের স্লুইসগেট এলাকায় নদীপাড়ে এক ঝুপড়ি ঘরে। তিনি বলেন, ‘আমরা কম্বল, কাঁথা কিছুই পাইনি। কাজ-কর্ম নেই। খাবারের অভাব। পুরোনো ঘর। বাইরে থেকে বাতাস ঢোকে। রাতে অনেক কষ্ট হয়। কেউ কম্বল দেয়নি। অনেক কষ্টে আছি। কেউ খোঁজও নেয় না।’

কুড়িগ্রাম সদরের দাড় মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা মালেকা বেগম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো গরম কাপড় বা অন্য কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। এই এলাকায় অনেক গরিব মানুষ। চরাঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ।’

কুড়িগ্রাম জেলা রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেন, ‘উলিপুরে নিবন্ধিত শ্রমিক আছে ২ হাজারের মতো; জেলা সদরে ৩ হাজার। এর বাইরে অনেক রিকশাচালক আছেন। উলিপুরের কোনো রিকশাচালক এখন পর্যন্ত একটা কম্বল বা কোনো খাদ্য সহায়তা পায়নি। শীতে আয় কমে গেছে ৫০ শতাংশ।’

কুড়িগ্রাম কুলি শ্রমিক ইউনিয়নের সর্দার মো. সিদ্দিক বলেন, ‘সদর উপজেলায় ৫১৫ জন শ্রমিক আছে। শীতের কারণে কাজ বন্ধ। অথচ একজনও সরকারের কোনো সহায়তা পায়নি।’

কুড়িগ্রামের জনসংখ্যা ১৮ লাখের বেশি। উপজেলা ৯টি। স্থানীয় এনজিও কর্মী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের হিসাবে জেলায় কমপক্ষে চার লাখ লোকের এখন কাজ নেই। তারা বছরের অন্য সময়ে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে কাজ করে। তারা এখন খুব কষ্টে আছে। যাদের হাতে কাজ আছে, তারাও শীতের কারণে কাজ করতে পারছে না। তাই এখন তাদের গরম কাপড় ছাড়াও খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দরকার।’

উন্নয়নকর্মী ইবনুল সাঈদ রানা জানান, এবার সরকারি সহায়তা কম। এনজিওগুলোও খুব বেশি সহায়তা করছে না। রাজনৈতিক নেতারা নেই শীতার্ত মানুষের পাশে। কিছু কম্বল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষের বাইরে যেতে গরম কাপড় দরকার। তা পাওয়া যাচ্ছে না। দরকার খাদ্য। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে চার লাখ মানুষের সহায়তা দরকার এই শীতে। কিন্তু পাচ্ছে অনেক কম।

রাজধানী ঢাকায়ও এই শীতে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষ কষ্টে আছে। মোহাম্মদপুরের রিকশাচালক আব্দুর রহমান বলেন, ‘নিজের ও পরিবারের জন্য কম্বল বা গরম কাপড় কিনতে পারছি না। শীতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কোনো সহায়তা পাচ্ছি না।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের চাহিদা অনুযায়ী কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থের কোনো সংকট নেই। চাহিদা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। শীতার্ত যে সংখ্যক মানুষের কথা বলা হচ্ছে, আসলে সে রকম নেই। কারণ বছর বছর তো কম্বল দেওয়া হয়। একটি কম্বল কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। আগের বছর যাকে কম্বল দেওয়া হয়েছে, এ বছর তাকে কম্বল দেওয়া হচ্ছে না।’

পাঁচ জেলায় শৈত্যপ্রবাহ, বিস্তারের আভাস

রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, পঞ্চগড় ও চুয়াডাঙ্গায় গতকাল বৃহস্পতিবার বয়ে গেছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তা আরও বিস্তারের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল নওগাঁর বদলগাছীতে। এ সময় ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এ পরিস্থিতির বিস্তার হতে পারে এবং আরও দুই থেকে তিন দিন শৈত্যপ্রবাহ থাকবে।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান জানান, জেলার ওপর দিয়ে আবারও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে গত বুধবার ভোর ৬টায় ছিল ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button