এ বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন চায় বিএনপি, অভিন্ন দাবি মিত্রদেরও
প্রয়োজনীয় সংস্কার দু-তিন মাসেই করা সম্ভব : ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের * ইসি প্রস্তুত, এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারিখ নির্ধারণ জরুরি : সাইফুল হক * জনগণের উপলব্ধি রাজনৈতিক সরকার ছাড়া সংকট কাটবে না : শাহাদাত হোসেন সেলিম
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে বিএনপিসহ মিত্ররা। অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে একাট্টা দলগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে একমত বিএনপির মিত্র অন্তত ৫২টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন তা দুই থেকে তিন মাসেই শেষ করা সম্ভব। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ বছরের মাঝামাঝিতেই নির্বাচন দেওয়া উচিত। তারা মনে করেন, সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাড ঘোষণার লক্ষ্যে আয়োজন করতে পারে একটি জাতীয় সংলাপের। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত সব রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দ্রুত সংলাপে বসে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করতে পারে। অন্যথায় সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়বে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা অস্থিরতাও নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। মঙ্গলবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ বছরের মাঝামাঝি অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার জন্য তিনি সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। নির্বাচন যত বিলম্ব হচ্ছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বিএনপির এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে জামায়াতে ইসলামী বলছে, জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন তা দুই থেকে তিন মাসে শেষ করা সম্ভব। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে এ বছরের মাঝামাঝিতেই নির্বাচন দেওয়া উচিত। ইসলামী আন্দোলন বলছে, এত বেশি কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়, যাতে মানুষের মধ্যে বিরক্তি, ক্ষোভ তৈরি হয়। আবার এত বেশি তড়িঘড়ি করাও ঠিক নয়। ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, চারদলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, এলডিপিসহ মিত্র দলগুলো অভিন্ন সুরে বলেছে, দেশের যে পরিস্থিতি তাতে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দরকার। এ বছরের মাঝামাঝি সময়েই তা সম্ভব। সেটা না হলে সংকট আরও বাড়বে। ছয়দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটও দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য তৈরির জন্য দুই থেকে তিন মাসের বেশি সময় লাগার কোনো কারণ নেই। জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন তা দুই থেকে তিন মাসে সম্পন্ন করা সম্ভব। বিএনপির বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তারাও (বিএনপি) বলেছে, কতিপয় সংস্কার প্রয়োজন এবং সংস্কার করেই নির্বাচন হোক। এক্ষেত্রে আমি কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখি না।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, ৫ আগস্ট এমনিতেই বিজয় অর্জন হয়নি। এটি রাজনীতিবিদদের ত্যাগ, দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফলে হয়েছে। রাজনীতিবিদরা দীর্ঘ ১৫ বছর আন্দোলন করে মাঠ উত্তপ্ত করেছেন। জুলাই মাসে ছাত্র-জনতা ও রাজনীতিবিদরা একত্রে মাঠে নামলে হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। আমাদের এখন মূল বিষয় হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, এত বেশি কালক্ষেপণ করা ঠিক নয় যাতে মানুষের মধ্যে বিরক্তি, ক্ষোভ তৈরি হয়। আবার তড়িঘড়ি করাও ঠিক নয়। সবদিক থেকেই তড়িঘড়ি করলে ভালো ফলাফল আসবে বলে মনে হয় না।
ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকার অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকলে দেশের জন্য বহুমুখী ঝুঁকি বাড়বে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন তো প্রস্তুত। আরও যে প্রস্তুতি প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন তা আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে শেষ করতে পারে। সেদিক থেকে এ বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে থাকত, তা হলে দুই-তিন মাস আগে-পরে হলেও তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলত না। বোঝা যাচ্ছে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে এড়িয়ে চলছে। নানা ধরনের ইস্যু, নন-ইস্যুকে সরকার ইস্যু করে তুলছে। সেজন্য বলছি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্বের জায়গাটা সরকারই তৈরি করছে। আর সামগ্রিকভাবে সরকার মানুষের প্রতাশ্যা অনুযায়ী দেশ চালাতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনকে সরকার একটা পরিষ্কার বার্তা দিতে পারে যে, আমরা অমুক সময় নির্বাচন চাই, আপনারা কাজের গতিটা বাড়ান। সেটা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারিখটা নির্ধারণ করা জরুরি।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরাও ইতোমধ্যে বলেছি ৩০ জুনের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। সরকার আন্তরিক হলে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। সংস্কার কমিটির সংস্কার প্রস্তাব দেওয়ার পর সেগুলো গ্রহণ ও সংযোজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে হবে। এর পরই নির্বাচনের ট্রেন চালু করা দরকার। কারণ সংস্কারগুলো কিন্তু নির্বাচিত সংসদেই বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা মনে করি সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের এক হতে হবে। এরপর যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সেই দলকে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটা যদি আমরা ক্ষমতায় আসি সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করব। বিরোধী দলে থাকলে সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর যত ধরনের চাপ দেওয়া দরকার তা দেব। সংস্কারগুলো আমরা সর্বজনীনভাবে গ্রহণ করব।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সরকারের দুর্বলতাগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে। জনগণের মধ্যে এই উপলব্ধি হয়েছে, রাজনৈতিক সরকার ছাড়া চলমান সংকটগুলো সমাধান সেভাবে করা যাবে না। আমরা চাই অনির্বাচিত সরকারের যেহেতু জবাবদিহিতা নেই, তাই জবাবদিহিতার সরকার প্রতিষ্ঠা হোক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার সফল হতে পারছে না। এটা আমাদের পীড়া দিচ্ছে। এই সরকার তো আমাদের, তারা যেন সুন্দরমতো একটা সেইফ এক্সিট নিতে পারে, সেজন্য আমরা চাই দ্রুত নির্বাচন।
১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কেউ ম্যান্ডেট দেয়নি। সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে একটা জাতীয় নির্বাচন দেওয়া, সেই নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তারা সংস্কারের নামে কালক্ষেপণের চেষ্টা করছে বলে অনেকে মনে করছেন। সংস্কারগুলো তো সংসদে পাশ করতে হবে। এই সরকারকে প্রথম থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছি। আমরা বলছি, অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিন। তা না করে সরকার যদি নির্বাচন দেরিতে দেয় তাহলে মানুষ মনে করবে আবার মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের মতো এরাও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চাইছে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিচার বিভাগ সংস্কার করা। ন্যূনতম যে প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া যায় ততটুকু করতে পারে। এই সরকার তো রাজনৈতিক সরকার নয় যে, তাদের সবকিছু করতে হবে। এটা তো এই সরকারের দায়িত্ব নয়। তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়া উচিত। তবে আমরা সব সময় জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার উচিত সব রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানে যেসব শক্তি জড়িত ছিল তাদের সমন্বয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা। সেই সংলাপের মাধ্যমেই যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সরকারের কোনো পরিকল্পনা আমরা জানি না, তারা কোনো রোডম্যাপও দেয়নি। আনলিমিটেড অথবা পরিকল্পনাবিহীন কোনো কিছুই ভালো নয়। সরকারের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার লক্ষ্যে একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা।
প্রায় অভিন্ন মত ছয়দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটের। এই জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সরকারকে আমরা অনেক আগেই জানিয়েছিলাম, বর্তমান সংকট উত্তরণে এবং জনগণের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার। আরও বলেছিলাম, ডিসেম্বরের অনেক আগেই নির্বাচন সম্ভব। ১৫ জানুয়ারির (আজ) মধ্যে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার জন্য বলেছিলাম। ইতোমধ্যে অনেক দল ’২৫ সালের মধ্যে তো বলেছেই, কেউ কেউ বছরের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলেছেন। আমার মনে হয় আমাদের চিন্তায় অভিন্নতা আছে। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার দ্রুতই সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করবে এমনই আশা করছি।
তিনি বলেন, দ্রুত নির্বাচনসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমাদের সমাবেশ রয়েছে। আর ২১ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আমরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করব। সেই সময়ও আমরা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাব। আশা করি সরকার এর আগেই নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করবে।