Hot

সংবিধানে বড় পরিবর্তনের সুপারিশ

ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোসহ সংবিধানে আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতাও হতে পারবেন না।

অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সুপারিশের সারসংক্ষেপ পরে কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

সংবিধানের মূলনীতি ও সংসদের কাঠামোতে পরিবর্তন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো, মৌলিক অধিকারের পরিসর বাড়ানো, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সংবিধানের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সদস্যদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, লেখক ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী মো. মুসতাইন বিল্লাহ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি সালেহ উদ্দিন সিফাত। কমিটিতে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও অন্য সদস্যরা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। এ সময় অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন তিন মাস ধরে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তারই সারাংশ উপস্থাপন করেছে। তবে এর পেছনে আছে অন্ততপক্ষে এক লাখ মানুষের মতামত, আছে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের অবদান, আছে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মত এবং সেগুলোকে ধারণ করার চেষ্টা। কমিশনের সদস্যরা ছাড়াও আরও ৩২ জন গবেষক এই কাজে যুক্ত ছিলেন বলে জানান তিনি।

আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের সুপারিশের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিকরণ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। আর প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানের নাম হিসেবে উল্লেখ আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংবিধানের প্রস্তাব হিসেবে বলা হয়েছে, ‘জনগণের সম্মতি নিয়ে আমরা এই সংবিধান জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করছি।’

দেশের বিদ্যমান সংবিধানে আছে বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে। কমিশন সুপারিশ করেছে, সংবিধানের প্রযোজ্য সব ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ এবং ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ ব্যবহৃত হবে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলো থাকছে।

এ ছাড়া নাগরিকত্ব হিসেবে ‘বাঙালি’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কমিশন ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি…’ এই বিধান বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬ (২) ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ “বাংলাদেশি” বলে পরিচিত হবেন’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করার সুপারিশ করেছে।

গণতন্ত্রসহ নতুন ৫ মূলনীতির সুপারিশ

রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র বহাল রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার নতুন আরও চারটি মূলনীতির সুপারিশ করেছে তারা।

বর্তমানে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে চার মূলনীতি রয়েছে, সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি গৃহীত হয়েছিল।

অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সংস্কারের সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সৌজন্যে

সুপারিশ করা পাঁচ মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে এই পাঁচটি নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে।

আর তিন মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এ–সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা

বর্তমানে ৩৫০ জন সংসদ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংরক্ষিত নারী আসনের ৫০ জন সদস্য নির্বাচিত হন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে। আইনসভার নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে হবে নিম্নকক্ষ। এর মধ্যে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। আর ১০০ জন নারী সদস্য সারা দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে।

এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স চার বছর কমিয়ে ২১ বছর করা, দুজন ডেপুটি স্পিকার রাখা; যাঁদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানের যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।

আরও একটি বড় সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা বলেছে, অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সব সময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশন বলছে, উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে। তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাকি ৫টি আসন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবেন। যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন।

উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। আর উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারদলীয় সদস্য ব্যতীত উচ্চকক্ষের অন্য সব সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।

সংস্কার কমিশন বলেছে, সংবিধানের যেকোনো সংশোধনীতে উভয় কক্ষের দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন লাগবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।

আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়ে কমিশন বলছে, জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে, এমন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করার আগে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে।

সাংবিধানিক কাউন্সিল

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তাঁরা দেখেছেন, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্র মোকাবিলা করেছে। ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। এ কারণে যাতে কোনো একক ব্যক্তির কাছে বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সে জন্য ভারসাম্যের বিষয় হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছেন।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে হবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধীদলীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে হবে এই কাউন্সিল। নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানসহ কিছু পদে নিয়োগের জন্য কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে।

রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মেয়াদ পাঁচ বছর। সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। যেসব ভোটারের সমন্বয়ে নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হবে, তাঁরা হলেন—এক. আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য (একটি করে ভোট)। দুই. প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট [উদাহরণ: ৬৪টি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’ থাকলে ৬৪টি ভোট]; তিন. প্রতিটি ‘সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’ সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ থেকে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

প্রধানমন্ত্রী

সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবেন। আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জন করতে পারছেন না, তবে রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন। একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যেকোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন, তাঁর জন্য এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।

অন্তর্বর্তী সরকার, মেয়াদ

নির্বাচন করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এটি মূলত কাজের দিক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। এ বিষয়ে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেগুলো হলো কমিশন আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ, সরকারের প্রধান ‘প্রধান উপদেষ্টা’ বলে অভিহিত হবে, আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন।

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ

সংবিধান সংস্কার কমিশন উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন চালুর সুপারিশ করেছে। তবে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশনের (জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্টস কমিশন) সুপারিশ করা হয়েছে। এর সদস্যরা হবেন প্রধান বিচারপতি (পদাধিকারবলে কমিশনের প্রধান) ; আপিল বিভাগের পরবর্তী দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারক (পদাধিকারবলে সদস্য); হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতি (পদাধিকারবলে সদস্য); অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন নাগরিক (সংসদের উচ্চকক্ষ কর্তৃক মনোনীত)।

কমিশন অধস্তন আদালতের পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে। স্থানীয় আদালতের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত থাকবে। এ জন্য একটি বিচারিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া কমিশন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে।

জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ

সংস্কার কমিশন সংবিধানের অধিকার–সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সংবিধানে কিছু নতুন অধিকার যেমন খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, ইন্টারনেটপ্রাপ্তি, তথ্য পাওয়া, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ, গোপনীয়তা রক্ষা, ভোক্তা সুরক্ষা, শিশু, উন্নয়ন, বিজ্ঞান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিদ্যমান অধিকারের অনুচ্ছেদগুলো সংস্কার যেমন বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের সীমিত তালিকা বর্ধিতকরণ, জীবনের অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা এবং নিবর্তনমূলক আটকসংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

শক্তিশালী স্থানীয় সরকারে জোর

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়েছে কমিশন। জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কর্মসূচির অংশ না হলে, স্থানীয় পর্যায়ে সব উন্নয়নকাজের ওপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এবং বাস্তবায়নের কর্তৃত্ব থাকবে। যেসব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী স্থানীয় সরকারের কাজে সরাসরি নিয়োজিত, তাঁরা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধীন হবেন। এ ছাড়া একটি স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে কমিশন।

গতকাল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, একটি ব্যাপক গণ–অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় তাঁরা এই প্রস্তাবগুলো রেখেছেন। তাঁরা আশা করছেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।

উল্লেখযোগ্য সুপারিশ

  • ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
  • পাঁচ মূলনীতি হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
  • দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, সংসদের মেয়াদ ৪ বছর।
  • নিম্নকক্ষে ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী। ২১ বছর হলে প্রার্থী হওয়া যাবে।
  • অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
  • নারী আসনেও সরাসরি ভোট।
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button