১.৭৭ লাখ কোটি টাকার ঋণের মামলায় মাত্র ২০ শতাংশ আদায় করেই নিষ্পত্তি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, খেলাপি গ্রাহকদের মামলার নিষ্পত্তির বিপরীতে সবচেয়ে কম আদায় হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এসব আদালতের মাধ্যমে পাওনা ছিল ১.০৫ লাখ কোটি টাকা; এরমধ্যে তারা আদায় হয়েছে মাত্র ১৭.৪৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন আদালতের মাধ্যমে ১.৭৭ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে; যার মধ্যে মাত্র ৩৫,৭৮০ কোটি টাকা বা মোট পরিমাণের ২০.২৫ শতাংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকের পরিচালকদের যোগসাজশে সার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের ওভারভেলুয়েশন ও গ্রাহকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াও ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, দেশের চার ধরনের আদালতের মাধ্যমে খেলাপিদের থেকে পাওনা আদায়ে মামলা করা হয়। এই আদালতগুলো হলো—অর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া আদালত, সার্টিফিকেট আদালত ও জেলা পর্যায়ের অন্যান্য আদালত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, খেলাপি গ্রাহকদের মামলার নিষ্পত্তির বিপরীতে সবচেয়ে কম আদায় হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এসব আদালতের মাধ্যমে পাওনা ছিল ১.০৫ লাখ কোটি টাকা; এরমধ্যে তারা আদায় করেছে মাত্র ১৭.৪৬ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চার ধরনের আদালতে খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬৫,০৫৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে আদায় হয়েছে ১৫,২৬৬ কোটি টাকা বা ২৩.৪৫ শতাংশ।
এছাড়া, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৪,৭৩৮ কোটি টাকা, এরমধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ১,৭৭৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “অনেক ঋণ বস্তবতার কারণে নিষ্পত্তি করা হয়। কারণ গ্রাহক মারা যায় কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখন মামলা করে শুধুই ব্যাংকের খরচ।”
তিনি আরও বলেন, “ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক যোগাসাজোশ থাকে। তারা ঋণের বিপরীতে যে জামানত নেয়, দেখা যায় তারা মূল্য ঋণের তুলনায় খুবই কম। এছাড়া, একই জামানত বারবার ভেলুঅ্যাডিশন করে অতিরিক্ত মূল্য দেখায়। যখন ঋণ খেলাপি হয়ে যায়, তখন আদায় করতে গিয়ে ঋণের আসলও আদায় করা যায়না।”
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হলেও অর্থ আদায় না হওয়ার কারণ হলো, বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই না করা।”
“ফলে মামলা নিষ্পত্তি হলেও ব্যাংক অর্থ আদায় করতে পারে না। আর এ সবই হচ্ছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।”
“মালিকপক্ষ এবং প্রভাবশালীরা চাপ প্রয়োগ করে ঋণ দিতে বাধ্য করেন, যা ব্যাংকখাতের জন্য একটি বড় সমস্যা,” যোগ করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, “অর্থঋণ আদালতে ব্যাপক অঙ্কের টাকার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, কিন্তু আদায় হয়েছে খুবই কম। এর অন্যতম কারণ গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে জামানত (মটগেজ) রাখা হয়, তার অতিরিক্ত মূল্য ধরা।”
তিনি বলেন, “কিছুদিন পর অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায় কিংবা মালিক মারা যায়, তখন ঋণ আর আদায়ের সুযোগ থাকে না। সে যেই মটগেজ রেখেছে, তা বিক্রি করেও দেখা গেছে নামমাত্র অর্থ আদায় হয়।”
“তবে এমন চিত্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ইঙ্গিত করে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহককে ঋণ দেয় না। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোগুলো কিছুদিন পর খেলাপি গ্রাহক হয়ে যায়,” যোগ করেন তিনি।
আদালতের জালে আটকে ব্যাংকের ২.৬৯ লাখ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের চার ধরনের আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ২.১৩ লাখ টি। এরমধ্যে ব্যাংকের পাওনা আটকে আছে ২.৬৯ লাখ কোটি টাকা।
এরমধ্যে অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে ৬৭.৫ হাজারটি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ২.০৯ লাখ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে ৮৩,৪৮৭ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের ১.২০ লাখ কোটি টাকা, এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকের ২,৪৭৮ কোটি টাকা।
এছাড়া, দেওয়ানি আদালতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি গ্রাহকদের বিপরীতে মামলা রয়েছে ৪২,১১৫টি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে ৫৮,১২৬ কোটি টাকা।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ আটকে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকের ৪৭,৩৪৯ কোটি টাকা, এরপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে ৯,১৩১ কোটি টাকা।
এছাড়া, সার্টিফিকেট আদালতে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে ৪৩১ কোটি টাকা ও দেউলিয়া আদালতে রয়েছে ১,১৮৪ কোটি টাকা।
গ্রাহকের খেলাপি ঋণ রাইট-আপ রয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকার উপরে
ব্যাংকখাতের খেলাপি গ্রাহকদের যেসব ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, সেসব খেলাপি ঋণ ব্যাংক রাইট-আপের মাধ্যমে ব্যালেন্স শিটের বাহিরে রেখেছেন, এমন পরিমাণ হলো ৮০,৮৩৬ কোটি টাকা।
এরমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের রয়েছে ২৩,৮৫২ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের ৫৫,১৪৩ কোটি টাকা ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ১,৪৯৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকখাতের বর্তমানে খেলাপি ঋণ
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে এনপিএল (নন-পারফর্মিং লোনস) ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকায় পৌঁছায়, যা রেকর্ড বৃদ্ধি।
সেপ্টেম্বরে মোট এনপিএল বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায়। এটি দেশের মোট বকেয়া ঋণের (প্রায় ১৬.৮৩ লাখ কোটি টাকা) ১৭ শতাংশ।