USA

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশই কি শেষ কথা

দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার পর প্রথম দিনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, তা কার্যত বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে থাকবে না, এগুলোর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে পুরো বিশ্বে।

অভিবাসনের ক্ষেত্রে তিনি যেসব পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন, তাতে নিজ দেশেই তাঁকে প্রতিবাদের মুখে পড়তে হচ্ছে। তিনি কয়েকটি দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছেন। চীনের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা থাকলেও প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। এ দুই দেশকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে শুল্ক দিতে হতে পারে ২৫ শতাংশ।

অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে তুলেছেন– এমন একটা কথা প্রচলিত থাকলেও অভিবাসনবিরোধী নীতির কারণে মার্কিন মুলুকে নথিপত্রহীন বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দেশে ফেরত আসার শঙ্কাও আছে কারও কারও মধ্যে। তবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অভিবাসনবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থাও জারি করেছেন। 

গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ট্রাম্প। প্রথা অনুযায়ী, শপথের দুই ঘণ্টার মধ্যে তিনি শতাধিক নির্বাহী আদেশে সই করেন। ‘নির্বাহী আদেশ’ মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বিশেষ ক্ষমতা, যার মাধ্যমে তারা আগের প্রেসিডেন্টের অনেক নির্দেশনাকে মুহূর্তেই বাতিল বা স্থগিত করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। ট্রাম্প যেসব আদেশ করেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি মার্কিন সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় মার্কিন কংগ্রেস বা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা করতে হতে পারে। 

নির্বাহী আদেশে এবার ট্রাম্প যেসব বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো– তিনি জন্মসূত্রে মার্কিনি হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ আদেশ এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত ২২টি অঙ্গরাজ্য ও দুটি শহরে আইনি লড়াইয়ে শরিক হয়েছে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংগঠন। 
রয়টার্স জানায়, মঙ্গলবার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে আইনি উপায়ে মোকাবিলা করতে আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। 

ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল আন্দ্রেয়া জয় ক্যাম্পবেল এক বিবৃতিতে বলেন, অভিবাসনের ওপর ট্রাম্পের কঠোরতা কমাতে এসব মামলা করা হয়। তাঁর আদেশ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবার বছরে দেড় লাখ শিশু নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে। ক্যাম্পবেল বলেন, কারও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেই। 

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে উল্লেখ আছে, কোনো শিশুর বাবা বা মা যদি মার্কিন নাগরিক না হন বা বসবাসের বৈধ অনুমতি না থাকে, তবে ওই শিশুকে নাগরিকত্ব প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। 

এ আদেশের বিরোধিতা করেছে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও লয়ার্স ফর সিভিল রাইটস। এরই মধ্যে সংগঠন দুটি নিউ হ্যাম্পশায়ার ও ম্যাসাচুসেটসে পৃথক মামলা করেছে। সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের প্রধান নির্বাহী অ্যান্থনি ডি রোমেরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া শিশুর নাগরিকত্ব অস্বীকার করাটা অসাংবিধানিক। এটা মার্কিন মূল্যবোধের পরিপন্থি। একজন প্রসূতি মাও দুটি মামলা করেছেন। 

মঙ্গলবার দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিকবিরোধী, বিশেষজ্ঞ বা অন্যরা সরব হচ্ছেন। তারা বলছেন, কলমের খোঁচায় ট্রাম্প যা করেছেন, সেটাই শেষ কথা হতে যাচ্ছে না। বিষয়গুলো প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমানারও বাইরে। এটা আদালত বা আইনপ্রণেতাদের কাছে যেতে পারে। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ ম্যাথু ডালেক বলেন, প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ সবাইকে হতবাক করেছে। এটা তাঁর সমালোচক, এমনকি ভোটার ও সমর্থকদেরও বিস্মিত করেছে। 

একই কথা বলেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের ক্লিনটন ইনস্টিটিউটের যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক স্কট লুকাস। তিনি বলেন, ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিল করতে চান প্রেসিডেন্ট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যারা জন্মগ্রহণ করেন, তারা মার্কিনি। এটা সংবিধানেই বলা আছে। ফলে বাতিলের আইনগত অধিকার কি তিনি রাখেন?’

তবে এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন হওয়ায় ট্রাম্পের জন্য এসব আদেশ বাস্তবায়ন অসম্ভব না-ও হতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি। সুপ্রিম কোর্টেও বিচারকদের অধিকাংশই রক্ষণশীল।

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর পাশাপাশি চীনা পণ্যে শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি পুনর্ব্যক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি চীনের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা ভাবছেন। 

চীন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার চীনা পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তবে চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর কারণ হিসেবে ট্রাম্প বলছেন, চীনের ব্যথানাশক ফেন্টানিল মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ করে। অতিমাত্রায় ফেন্টানিল সেবনে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মারা যান। ট্রাম্প মনে করেন, আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক লাভ হবে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এসব শুল্কের ভার শেষমেশ ভোক্তাদের ঘাড়েই পড়বে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে থাকা নথিপত্রহীন ১৮ হাজার অভিবাসীকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভারত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনই তাদের চিহ্নিত করেছে। এ সংখ্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট বা আইসিইর তথ্য মিলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইসিই গত বছর নভেম্বরে প্রকাশিত এক তথ্যে জানিয়েছিল, ১৭ হাজার ৯৪০ ভারতীয়কে প্রত্যর্পণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদন জানায়, অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল্লির তরফে ট্রাম্প প্রশাসনকে একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে ওয়াশিংটন কোনো ধরনের বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ আরোপ না করে।

যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ অবৈধ অভিবাসী চিহ্নিত করে থাকে। এগুলো হলো– অফিস অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন ও ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট। তিনটি বিভাগেরই ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, যে কয়েকটি দেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে তালিকার ওপরের দিকেই রয়েছে ভারত। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তালিকায় সবার ওপরে চীন। তার পর ভারতের অবস্থান। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button