মল্যস্ফীতির চাপে অর্থনীতি: উচ্চ মূল্যস্ফীতি চেপে ধরেছে অর্থনীতিকে
উচ্চ মূল্যস্ফীতি চেপে ধরেছে অর্থনীতিকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়ে যাওয়া এই মূল্যস্ফীতিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাগে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে অর্থনীতির ওপর তা প্রচ- চাপ সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, এই মূল্যস্ফীতি দেশের কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেঁকে বসা এই মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে মানুষের প্রকৃত মজুরি।
পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকরা কথায় কথায় উন্নত দেশের উদাহরণ দেন। বিশেষ করে অনেক নীতি নির্ধারককে প্রায়ই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তুলনা দিতে দেখা যায়। চলতি বছরের জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে। গত ১৬ আগস্ট যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, ভোক্তা মূল্যসূচক ৬ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা জুনের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কম। এতে সেখানের জীবনযাত্রার ওপর চাপ কিছুটা কমছে। ফলে স্বস্তি ফিরছে দেশটির জনজীবনে। দেশটিতে জুলাইতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমেছে। কিন্তু খাদ্যের দাম এখনো বেশি। তবে তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখনো কম। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বেশ কয়েকবার সুদের হার বাড়িয়েছে। অথচ ব্রিটেনের পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া নিয়ে বিক্ষোভও করেছিল সেখানকার মানুষ।
দেশে দেশে কমছে মূল্যস্ফীতি ॥ জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইতালিতে মূল্যস্ফীতি ৭.৬ শতাংশ, জার্মানিতে ৬.১ শতাংশ, ফ্রান্সে ৫.১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৪ শতাংশ, কানাডায় ৩.৪ শতাংশ এবং জাপানে ৩.২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। আর জি-৭ দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৪.৬ শতাংশ, যা আমাদের দেশের অর্ধেকেরও কম। গত বছরের মার্চে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির পারদ প্রায় ৯ শতাংশে উঠেছিল; যা ছিল ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। জি-৭ দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির এই হিসাব হচ্ছে গত মে মাসের। এখন মূল্যস্ফীতি আরও কম।
টানা চার দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর, গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে সেটি নয় দশমিক এক শতাংশ থেকে নেমে ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গ্রুপ অব সেভেন বা জি-৭ ভুক্ত ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আগে জি-৭ ভুক্ত দেশের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সর্বোচ্চ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সফলতাকে ত্বরান্বিত করেছে জ্বালানির দাম। জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনায় যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমে গেছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি যখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন চীনে দেখা যাচ্ছে উল্টো অবস্থা। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে ঋণাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। সেখানে গত জুলাই মাসে কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) বা ভোক্তা মূল্যসূচক আগের বছরের তুলনায় ০.৩ শতাংশ কমে গেছে। গত দুই বছরের মধ্যে প্রথমবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে চীনে।
মূল্যস্ফীতি হলে কোনো কিছু কিনতে বেশি দাম দেওয়া লাগে, চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের তুলনায় অর্থের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। আর মূল্য-সংকোচন হচ্ছে তার উল্টো। এতে পণ্য বা সেবার দাম কমে যায় এবং অর্থের মূল্য বাড়ে। অর্থাৎ, একই দামে আগের চেয়ে বেশি জিনিসপত্র কেনা যায়।
এর ভালো খবর হচ্ছে, অন্য দেশগুলা এখন তুলনামূলক কম দামে চীনের পণ্য কিনতে পারছে, যা তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে নিত্যপণ্যের দামের কথা শুনলেই এক সময় আঁতকে উঠতে হতো। সেই আফগানিস্তানে জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৮। দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এখন (জুলাই) ৬.৩ শতাংশ। অথচ শ্রীলঙ্কায় আগের মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। মাসের ব্যবধানে প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আলোচিত এ দেশটি। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, গত সেপ্টেম্বরে যখন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট চরমে, তখন মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল রেকর্ড ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। কিন্তু পরের ১০ মাসে সেই মূল্যস্ফীতি ১০ গুণেরও বেশি কমিয়ে এনেছে লঙ্কান সরকার। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রেখেছে মূলত খাদ্যপণ্যের দাম কমানো। গত ১২ মাসে দেশটিতে খাদ্যমূল্য কমেছে অন্তত ১ দশমিক ৪ শতাংশ। শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই নয়, দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এই দেশটি নাটকীয়ভাবে মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিতে কাবু হয়ে থাকা মধ্য আফ্রিকায় মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ শতাংশের বেশি। কিন্তু জুন মাসে তাদের মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ইউরোজোনে যে উনিশটি দেশে ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা হয় সেসব দেশে গত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১০ শতাংশে পৌঁছেছিল। এই অঞ্চলে ইউরো সাধারণ মুদ্রা হওয়ার পর থেকে এমনটা কখনো দেখেনি ইউরোপ। সেই ইউরোজোনের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) এখন লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসা।
ট্রেড ইকোনমিকসের তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে এ মুহূর্তে বেশি মূল্যস্ফীতি রয়েছে পাশের দেশ মিয়ানমার ও পাকিস্তানে। শুধু দক্ষিণ এশিয়াই নয়, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো ব্যর্থ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই শেষে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অথচ চলতি অর্থবছরের সরকারের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের মধ্যে।
বাংলাদেশ কেন পারছে না ॥ বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশেই স্পর্শকাতর এ সূচকটি সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। বরং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটর কারসাজি এই মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আগের মাস অর্থাৎ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে।
আর ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২২ সালের জুলাই মাসে দেশের মানুষ যে খাদ্য ১০০ টাকায় পেয়েছিলেন, চলতি বছরের জুলাইয়ে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৭৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
সরকারি হিসেবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বর্তমানে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতিও ৯ শতাংশের বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু বছর শেষে তা গড়ে ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ঊর্ধ্বমুখী দামের সমন্বয়ও মূল্যস্ফীতি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হারে নিয়ন্ত্রণ আসছে না। বরং তা বেড়েই চলেছে। এ দুই কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের ঘর থেকে বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। অবশ্য স্বাধীন গবেষণা সংস্থাগুলো বলেছে, দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। সরকার, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সব মহলেরই মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার ব্যাখ্যা থাকে ‘রাশিয়া-ইউক্রেন’ যুদ্ধ। যদিও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে. বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কাও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তির দিকেই।
এমনকি চলতি বছরের জুন ও জুলাইয়ে বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারও প্রায় দশ শতাংশের কাছে উঠে এসেছে। অথচ বিশ্ববাজারে কৃষি ও শস্যজাতীয় খাদ্যের দাম কমেছে। এমনকি খাদ্য উৎপাদন হয় এমন দেশগুলোতে ভালো আবহাওয়া এবং বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে আসার কারণেও খাদ্য মূল্য পড়তির দিকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকা, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে অন্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে সমর্থ হলেও বাংলাদেশ পারছে না।
বাংলাদেশ পারছে না কেন ॥ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশে দেশে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় সুদের হারকে। বিশ্বের প্রায় সব দেশই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এটি করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও তাদের দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গত জুনের মুদ্রানীতিতে সুদের হার কিছুটা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও তা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করা হলেও পরোক্ষভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, অন্য দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে না কমার কারণ হচ্ছে, অন্য দেশগুলো সতর্ক হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন বাংলাদেশে যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাহলে সুদের হার আরও বাড়াতে হবে। সুদের হার না বাড়ালে মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ মানেই ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এটি প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ-সরকার এটি কমানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ হাতে নেয়নি।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বা খাদ্য মূল্যস্ফীতি না কমার কারণ হিসাবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যুদ্ধটাই শুরু করেনি, বরং তাদের কিছু পদক্ষেপ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, তারা ডলার সংকট মোকাবিলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এগুলো সব ধরনের পণ্য আমদানিতেই প্রভাব ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমদানি কমানো। কিন্তু এটি করতে গিয়ে খাদ্যপণ্যের জোগান কমে গেছে। সে কারণে স্থানীয় বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘২০২১-২২ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল। যার প্রভাবে বাংলাদেশেও খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এসব পণ্যের দাম যখন কমা শুরু হয় তার আর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়েনি।’
তার মতে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমাতে যে বড় অস্ত্র ব্যবহার করেছে সেটি হলো সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে, কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। তাছাড়া এখানে বাজারে কারসাজির প্রবণতা আছে যা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ঠেকাতে পারছে না। আবার মার্কেট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। বিশেষ করে চিনি, তেল, চাল ও পেঁয়াজের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হঠাৎ হু হু করে বেড়ে যায়, যার সঙ্গে চাহিদার কোনো সম্পর্কই নেই। এসব কারণেই দাম অনেক বাড়ার পর আর কমে না।
তার সঙ্গে একমত অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমানও। তিনি বলেন, মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা জরুরি। অর্থাৎ উৎপাদন, চাহিদা, ঘাটতি, আমদানি কোন পর্যন্ত করতে হবে, কখন দরকার- এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে নীতি নির্ধারকরা কোথায় কখন কোন পণ্যের ঘাটতি হবে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আবার বাজারে যে নজরদারি দরকার সেটা না থাকায় যেসব পণ্য উৎপাদক ও আমদানিকারক কম সেখানে দাম অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এসব ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখেনি বলেই বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে যখন দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যায় তখন টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তখন যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে তার অনেকগুলোর দাম আর কমেনি।’
মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে প্রকৃত মজুরি ॥ গত এক বছর ধরেই মজুরি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। যা দেশের কর্মসংস্থান ও ক্রয় ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূলত ২০২২ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি হঠাৎ সাত শতাংশে লাফ দেওয়ার পর থেকেই মজুরি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। বাড়তে থাকে অর্থনীতির এই দুই সূচকের মধ্যে পার্থক্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০২২ সালের মে মাসে মজুরি ও মূল্যস্ফীতির সূচকের মধ্যে পার্থক্য ছিল সামান্য। ওই মাসে মজুরি সূচক (ওয়েজ রেট ইনডেক্স) ছিল ৬.৩৮ শতাংশ, আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪২ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে মজুরি সূচক ছিল ৬.২৮ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২৯ শতাংশ। অর্থাৎ এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে এই দুই সূচকের মধ্যে পার্থক্য বাড়তে শুরু করে। জুন মাসে দাঁড়ায় মজুরি সূচক ৬.৪৭ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ৭.৫৬ শতাংশ।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি এক লাফে ৯ শতাংশের ঘরে উঠে যায়। ওই বছরের শেষে তা ৮ শতাংশে নেমে আসলেও চলতি বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি আবার ৯ শতাংশের ঘরে উঠে আসে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯.৬৩ শতাংশ। কিন্তু মজুরি সূচক সেই ৭.১৮ শতাংশেই অবস্থান করে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করলেও মজুরি সূচক কমে সাড়ে ছয় শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। এতে এই দুই সূচকের মধ্যে পার্থক্যের কারণে মানুষের প্রকৃত মজুরি কমে গেছে।
বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। যার বেশির ভাগ মানুষই মজুরি পায়। এই মজুরি কমে যাওয়ায় তারা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা চলতে পারছে না। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের মধ্যে বড় পার্থক্যে দেশের উচ্চবিত্ত মানুষ বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলেও মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষ দিশাহারা অবস্থায় আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করছে। আর এই মূল্যস্ফীতি মানুষকে ‘পঙ্গু’ করে দিচ্ছে। যদি এই ব্যবধান অব্যাহত থাকে, দৈনিক মজুরিতে কর্মরতরা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাবে। আর এটা দেশের কর্মসংস্থানের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে সবচেয়ে বিপদে পড়েন সাধারণ মানুষ। আর সেই মূল্যস্ফীতির প্রথম খড়গ পড়ে গরিব মানুষের ওপর। সরকারের অব্যবস্থাপনা আর সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণেই আজকের এই দশা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, সরকার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বেশ কাজ করছে। কৃষক সুবিধাও পাচ্ছে নানাভাবে। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষকের ফলানো ফসলে ভাগ বসাচ্ছেন ‘অন্যজন’। এই ‘অন্যজনকে’ দমাতে না পারলে বাজারের অস্থিরতা কমবে না।
চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, এবার তার মূল লক্ষ্যই হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অর্থবছরের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।