মহাকাশ অভিযানের নতুন দিগন্ত দ্বিতীয়বার চাঁদে নামতে চলেছে আমেরিকান কোম্পানি

আমেরিকার মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনটুইটিভ মেশিনস দ্বিতীয়বারের মতো চাঁদে সফল অবতরণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বুধবার (স্থানীয় সময়) স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে তাদের অ্যাথেনা ল্যান্ডার সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
ইনটুইটিভ মেশিনস গত বছর প্রথমবারের মতো বেসরকারিভাবে চাঁদে রোবট পাঠিয়ে ইতিহাস গড়েছিল। তবে, সেবার ল্যান্ডারটি চাঁদের মাটিতে সঠিকভাবে অবস্থান নিতে পারেনি এবং পাশের দিকে কাত হয়ে পড়েছিল। এবার তারা সেই সমস্যার পুনরাবৃত্তি এড়াতে সচেষ্ট।
হিউস্টন-ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের ষড়ভুজাকৃতির ল্যান্ডার অ্যাথেনা ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ১৬ মিনিটে (গ্রিনিচ মান সময় বৃহস্পতিবার ০০:১৬) উৎক্ষেপণ করা হয়।
আগামী ৬ মার্চ এটি চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি মন্স মৌটন মালভূমিতে অবতরণ করবে, যা এর আগে কোনো মহাকাশযানের জন্য লক্ষ্যস্থল ছিল না।
অ্যাথেনা ল্যান্ডারের অভিনব বৈশিষ্ট্য
অ্যাথেনা ল্যান্ডারে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ড্রিল, যা চাঁদের পৃষ্ঠের নিচে বরফের অস্তিত্ব খুঁজবে। এছাড়া, এতে রয়েছে ‘গ্রেস’ নামের একটি হপিং ড্রোন, যা বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী গ্রেস হপার-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
এই ড্রোনটি চাঁদের খাড়া পাহাড়, পাথর ও গর্ত পেরিয়ে চলতে সক্ষম, যা ভবিষ্যতে মানুষের অভিযানকে সহায়তা করবে। এছাড়া, অ্যাথেনার সঙ্গে একটি ছোট রোভারও রয়েছে, যা নোকিয়া বেল ল্যাবসের উন্নত চন্দ্র-নেটওয়ার্ক পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হবে।
নোকিয়ার তৈরি এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ল্যান্ডার, রোভার ও হপিং ড্রোন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং ছবি ও ভিডিও পাঠাবে। ভবিষ্যতে এটি মহাকাশচারীদের স্পেসস্যুটের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইনটুইটিভ মেশিনসের প্রধান নির্বাহী ট্রেন্ট মার্টিন বলেন, হপার বা লাফিয়ে চলার সক্ষমতা থাকা ড্রোন ভবিষ্যতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে, বিশেষ করে চাঁদের গভীর গর্ত বা আগ্নেয়গিরির তৈরি সুড়ঙ্গ অন্বেষণে, যেখানে রোভার চালানো সম্ভব নয়।
এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র কয়েকটি সুসংগঠিত জাতীয় মহাকাশ সংস্থাই সফলভাবে চাঁদে সফট ল্যান্ডিং করতে পেরেছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি মহাকাশ অভিযানের প্রচলন ঘটাতে ‘কমার্শিয়াল লুনার পেলোড সার্ভিসেস’ (CLPS) প্রোগ্রাম চালু করেছে, যার মাধ্যমে তুলনামূলক কম খরচে নাসার যন্ত্রপাতি চাঁদে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে।
নাসার সহকারী প্রশাসক নিকি ফক্স বলেন, আমাদের প্রযুক্তিগত গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, যা ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহ অভিযানের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
পূর্বের ভুল শুধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
এর আগে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইনটুইটিভ মেশিনসের ওডিসিয়াস ল্যান্ডার চাঁদে সফলভাবে নামতে ব্যর্থ হয়েছিল। দ্রুত অবতরণের ফলে এটি একটি অংশ চাঁদের মাটিতে আটকে গিয়েছিল এবং ৩০ ডিগ্রি কাত হয়ে পড়েছিল। এর ফলে, এটি যথাযথভাবে সৌরশক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি এবং নাসার গবেষণাগুলোর একটি অংশ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়।
এবার, নতুন মিশনের জন্য ৬২.৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে, যা আগের তুলনায় কম ব্যয়বহুল।
মহাকাশযান চাঁদে অবতরণের সময় বাতাসের অভাবে প্যারাসুট ব্যবহার করা যায় না, তাই এটি সম্পূর্ণরূপে থ্রাস্টার নিয়ন্ত্রিত অবতরণের উপর নির্ভরশীল। এ কারণে অবতরণের সময় দিকনির্দেশনা ও গতি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। এইবার, ওডিসিয়াস মিশনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে লেজার অলটিমিটারের জন্য উন্নত তার সংযোগসহ বিভিন্ন কারিগরি পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা অবতরণের সঠিক উচ্চতা ও গতি নির্ধারণ করবে।
অন্য মিশনের প্রতিযোগিতা
অ্যাথেনার চাঁদে অবতরণের আগে, আগামী ২ মার্চ আরও একটি বেসরকারি মার্কিন ল্যান্ডার ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেসের ব্লু ঘোস্ট চাঁদে পৌঁছাবে। এটি জানুয়ারিতে টোকিও-ভিত্তিক আইস্পেসের ‘রেজিলিয়েন্স’ ল্যান্ডারের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিল।
একই রকেটে আরও রয়েছে নাসার ‘লুনার ট্রেইলব্লেজার’ প্রোব, যা চার মাসের যাত্রা শেষে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করবে এবং পরবর্তী দুই বছর চাঁদের বিভিন্ন ধরনের পানির অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করবে।
নাসার জন্য এইসব অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমানে সংস্থাটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। অনেকে মনে করছেন, নাসা হয়তো মহাকাশচারীদের চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করে সরাসরি মঙ্গল অভিযানের দিকে নজর দিতে পারে।
উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং স্পেসএক্সের প্রধান এলন মাস্ক উভয়ই মঙ্গলগ্রহ অভিযানের পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। তাই, চাঁদে সফল অবতরণ ভবিষ্যতে নাসার মহাকাশ কর্মসূচির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হতে যাচ্ছে।