সাত খুন মাফ? হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে দীর্ঘসূত্রতায় শুনানি

খাজনা আদায়ের স্বার্থে ব্রিটিশ নীলকররা সাতজন প্রজাকেও হত্যা করতে পারতেন। এ জন্য নীলকরদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হতো না। নীলচাষের বিরুদ্ধে সে সময় গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। কৃষকরা নীলকুঠি আক্রমণ করতেন। সেই আন্দোলন ও হামলা দমনে ব্রিটিশ সরকার নজিরবিহীন এক আইন করে। বলা হয়, এটি ছিল উপমহাদেশে দেয়া প্রথম ইনডেমনিটি। অর্থাৎ ব্রিটিশ নীলকররা সাতজন প্রজাকে খুন করলেও বিচার হতো না। এর জন্য তাদেরকে কারো কাছে দিতে হতো না কোনো কৈফিয়ত। কথিত এই ‘আইন’ থেকে ‘সাত খুন মাফ’ কথাটির উৎপত্তি। যা পরবর্তীতে বাংলা বাগধারায় পরিণত হয়।
ভারত পালিয়ে যাওয়া মাফিয়া রানী শেখ হাসিনা নিজ দলের লোকদের দিয়ে রেখেছিলেন এমনই ‘ইনডেমনিটি’। খুন করলেও বিচার নেই। লোকদেখানো বিচার করা হলেও রায়ের বাস্তবায়ন হয়নি। এমনটির প্রমাণ পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন, ত্বকী হত্যা এবং ঢাকায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার ক্ষেত্রে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেও বিচার হয়নি তার শাসনামলে সংঘটিত আলোচিত হত্যাকা-গুলোর। চাপে পড়ে কোনোটির ‘বিচার’ করলেও হাসিনা সরকার কার্যকর করেনি কোনো রায়। হাসিনা উৎখাতের পর চলে গেছে আট মাস। আলোচিত মামলাগুলোর বিচার এবং রায় কার্যকরের লক্ষণ নেই এখনো। হাসিনা রেজিমের বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান কবে ঘটবেÑ বলতে পারছেন না কেউ। এখন হাসিনা নেই। প্রভাবশালী আ.লীগ নেতা মায়াও লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাহলে আলোচিত এ হত্যা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের দ- কার্যকরে বাধা কোথায়?
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’। অর্থাৎ বিলম্বিত বিচারই হচ্ছে ‘বিচারহীনতা’। ১১ বছরেও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় শাস্তি কার্যকর হয়নি। যার অন্য অর্থ হচ্ছে, বিচারহীনতা। ‘বিচারহীনতা’র ফাঁকে কি তাহলে মাফ পেয়ে গেল সাত খুনের আসামিরা? হাসিনা মুক্ত বাংলাদেশে এখন এ প্রশ্ন সবার।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো গতকাল নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেছেন। বাদিপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন, হত্যাকা-ের শিকার নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, সিনিয়র অ্যাডভোকেট আওলাদ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, নিহত তাজুলের পিতা আবুল খায়ের, নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ, নারায়ণগঞ্জ জেলা বারের সভাপতি সরকার হুমায়ুন কবির, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ফারহানা মানিক সেখানে প্রমুখ বক্তৃতা করেন। বিক্ষোভ সমাবেশে তারা আসামিদের আপিল শুনানি শেষে দ্রুত মৃত্যুদ- কার্যকরের দাবি জানান।
সাত খুনের ১১ বছর পূর্তি ছিল গতকাল (২৭ এপ্রিল)। বিক্ষোভ সমাবেশের দাবি এবং এ বিষয়ে সরকারপক্ষের আইনি পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট’!
সাত খুন মামলার রায় কার্যকর কবে? : নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের রায় কার্যকর হয়নি ১১ বছরেও। এ মামলায় ২৬ জনকে মৃত্যুদ- দেয় নারায়ণগঞ্জ বিচারিক আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ জেল আপিল এবং সরকারপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্টের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ ১৫ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন। পরে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার দ-িতদের দিয়ে আপিল করায়। সেই আপিলে ঝুলে আছে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত হত্যা মামলার রায় বাস্তবায়নের বিষয়টি। কারণ এ মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি হচ্ছেন হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। তিনি ছিলেন র্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক। এ ছাড়া মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (চাকরিচ্যুত) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম এম রানা এবং সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর ও আ.লীগ নেতা নূর হোসেন। নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২৬ জনকে মৃত্যুদ- দেন। রায়ের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিপক্ষের আপিল শুনানি শেষে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ এবং বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ আপিলের রায়ে ৩৫ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন। মৃত্যুদ- বহাল আসামিরা হলেনÑ লে. ক. (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. ক. এম মাসুদ হোসেন, ল্যান্সনায়েক (অব.) বেলাল হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক (অব.) হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাবউদ্দিন, এসআই পুর্ণেন্দু বালা, সৈনিক (অব.) আবদুল আলীম, সৈনিক (অব.) মহিউদ্দিন মুন্সি, সৈনিক (অব.) আল আমিন শরিফ, সৈনিক (অব.) তাজুল ইসলাম, সিদ্ধিরগঞ্জ আ.লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন। এদের মধ্যে মহিউদ্দিন মুন্সি, আল আমিন শরিফ ও তাজুল ইসলাম পলাতক।
হাইকোর্ট মৃত্যুদ- হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন ১২ জনকে। তারা হলেনÑ সৈনিক (অব.) আসাদুজ্জামান নুর, সার্জেন্ট (অব.) এনামুল কবীর, নূর হোসেনের সহযোগী মর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু ওরফে মিজান, মো. রহম আলী, মো. আবুল বাসার, সেলিম, মো. সানাউল্লাহ ওরফে ছানা (পলাতক), ম্যানেজার শাহজাহান (পলাতক) ও জামাল উদ্দিন।
মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের মধ্যে মায়ার জামাতা তারেক মোহাম্মদ সাঈদ রয়েছেন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার উৎখাত পর্যন্ত কারাগারের ভেতর তিনি আরাম-আয়েশেই ছিলেন। বন্দিদের খাবার তিনি খেতেন না। তিন বেলা যেত বাসা থেকে রান্না করা খাবার। তার জন্য ছিল ‘বিশেষ ব্যবস্থা’। তবে হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর সেই ব্যবস্থা আর নেই।
আরেক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এম এম রানা রয়েছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ। আরিফ হোসেন রয়েছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি সেলে।
দেশকাঁপানো সেই সাত খুন : ১১ বছর আগের ঘটনা। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে উঠিয়ে নিয়ে যান। ঘটনার সময় একই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন নজরুলের আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে চিৎকার করেন। এ ঘটনায় তাকে (চন্দন সরকার) ও তার গাড়িচালককেও তুলে নিয়ে যায় র্যাব। পরে সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। একপর্যায়ে নিহতদের পেট কেটে লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে লাশ ডুবিয়ে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যায়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল ভেসে ওঠে ছয়জনের লাশ। একজনের লাশ ভেসে ওঠে পরের দিন। নিষ্ঠুর এ হত্যাকা-ের শিকার হন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, ব্যক্তিগত সহকারী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম।
সাত খুনের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে বিশ্বমিডিয়ায়ও। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা ঘটনার সন্দেহভাজন ও মূলহোতা হিসেবে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও নাসিকের ৪ নম্বর ওয়ার্ডেও তৎকালীন কাউন্সিলর নূর হোসেনের অফিস পুড়িয়ে দেয়। হত্যার বিচারের দাবিতে নজরুলের অনুসারী ও এলাকাবাসী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। কিন্তু ঘটনার পরপরই নারায়ণগঞ্জের গডফাদার, আওয়ামী এমপি শামীম ওসমানের সহযোগিতায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কাউন্সিলর নূর হোসেন। পরে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় ভারত সরকার নূর হোসেনকে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ফেরত পাঠায়। লোমহর্ষক এ হত্যাকা-ের তদন্তে বেরিয়ে আসে র্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ বাহিনীটির কয়েকজন বিপথগামী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা। আ.লীগ নেতা নূর হোসেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তারা ‘কন্টাক্ট কিলিং’ করে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র কাউন্সিলর নজরুলকে খুনের পরিকল্পনা থেকেই খুন হন সাতজন। হত্যাকা-ে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এলিট ফোর্স ‘র্যাব’। চাপে পড়ে আ.লীগও। কারণ সংশ্লিষ্ট তারেক মোহাম্মদ সাঈদ ছিলেন শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহচর ও তৎককালীন ত্রাণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মেয়ের জামাই।
মৃত্যুদ- হয় বিচারে : সাতজনের লাশ পাওয়ার ঘটনার এক দিন পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ছয় জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা থানায় অপহরণ ও হত্যা মামলা করেন। অন্যদিকে চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার অভিযোগে ওই বছর ১১ মে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চার্জ গঠন করে নারায়ণগঞ্জ জেলাজজ আদালতে শুরু হয় বিচার। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২৬ আসামির মৃত্যুদ- হয়। দ-িতদের মধ্যে ১৬ জনই র্যাবের (বরখাস্তকৃত) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্য। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত র্যাব-কর্মকর্তারা হলেনÑ তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, পুর্ণেন্দু বালা, আবু তৈয়ব, মো. শিহাব উদ্দিন, আবদুল আলীম, মহিউদ্দিন মুন্সি, আসাদুজ্জামান নূর, আল আমিন, তাজুল ইসলাম ও এনামুল কবীর। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অন্যরা হলেনÑ সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, তার সহযোগী মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, মর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। এ ছাড়া বিচারিক আদালতে অপহরণ ও আলামত গোপনের অভিযোগে র্যাবের আরো ৯ জনকে সাত থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়।
আসামিপক্ষের আপিল শুনানির দীর্ঘসূত্রিতা সম্পর্কে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, আপিল বিভাগে মামলা আসে ক্রমানুসারে। আমরা তো চাইব দ্রুত আপিলটির শুনানি করতে। আদালতের কিছু শৃঙ্খলা ও নিয়মের বিষয় রয়েছে।
কবে আলোচিত এ মামলার শুনানি হবেÑ জানতে চাওয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের কাছে। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।