ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে, ঘোরে না শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।
বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’
কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি।
এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’।
বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।
দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়।
মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন।
বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।
শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ
রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে।
প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড।
টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে।
অচল ব্যাংকে সচল করতে নতুন টাকা ছাপিয়ে দেয়া হলেও উৎপাদনমুখী সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’ গঠন ছাড়া তেমন কিছুই করেনি। নতুন করে বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না উল্টো গত কয়েক মাসে গার্মেন্টসসহ ১২৯টি মিলকারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকারের তালিকায় যোগ হয়েছে আরো প্রায় এক লাখ শ্রমিক; বেকারত্বের কারণে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বাড়ছে
ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানের পর গত ৯ মাসে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও শ্রমিক শ্রেণি মানুষের ভাগের পরিবর্তন ঘটেনি। টাকা ছাপিয়ে বড়লোকদের অচল কিছু ব্যাংকে সচল করেছে; অথচ মিলকারখানায় উৎপাদন বাড়ানো ও বেকারত্ব দূরীকরণে তেমন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় কলকারখানার চাকার গতি কমে গেছে। সূত্রের দাবি- অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এ সময় গার্মেন্টসসহ ১২৯টি মিলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারের তালিকায় যোগ হয়েছে আরো এক লাখ শ্রমিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান না হওয়া, কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে। বেকারত্বের জন্যই দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। কর্মক্ষম তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থান করা গেলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। দু’মাস আগে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তার অর্ধেক অর্জন করা সম্ভব হবে। ‘প্রান্তিক যুবসমাজের কর্মসংস্থানে সরকারি পরিষেবার ভ‚মিকা’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারকে বেকার শ্রমিকদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকার নতুন বিনিয়োগ আনতে পারছে না। দেশের মোট দুই কোটি যুবকের প্রায় ১২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। এর মধ্যে ৭৮ লক্ষ যুবকেরই চাকরিতে ঢোকার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ নেই। শহরের তুলনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেকার যুবকরা এসব ক্ষেত্রে সুবিধা করে উঠতে পারছেন না।
আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিবসটি মহান মে দিবস হিসেবে পালিত হয়। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আন্দোলনে শ্রমিকরা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন; তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। এ দিবসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে জাতীয় ছুটির দিন। মহান মে দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দিবসটি পালনের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়ে দিবসটি পালিত হলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ৯ মাস হয়েছে। এ সময় নতুন বিনিয়োগ না আসায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ফলে শ্রমবাজারে বেকারের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। অন্যদিকে প্রায় ১২৯টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। এসব কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৯ মাসে শ্রমিকদের জন্য কেবল ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। ‘শ্রম অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নে ১৭ নভেম্বর শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। ১০ সদস্যের কমিশন ২১ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চলতি মাসের প্রথম দিকে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ বিনিয়োগ সম্মেলন করে। এ সম্মেলন আগামী বুধবার পর্যন্ত চলবে। বিশ্বের ৫০টি দেশের ৫৫০ জনের বেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশ নেয়। বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রæতির কথা জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো বিনিয়োগ নেই। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ইংরেজিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করায় তাকে নিয়ে ধন্যধন্য পড়ে গেছে। কিন্তু নতুন কেউ বিনিয়োগ করছে এমন কোনো তথ্য নেই।
পোশাক শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সাড়ে ৮ থেকে ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে গাজীপুরে রয়েছে ৫৪টি, চট্টগ্রামে ৫২টি, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ২৩টি এবং সাভার ও আশুলিয়ায় ১৮টি। এসব কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। কারখানা বন্ধের ফলে বেকার শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন।
সূত্র জানায়, গাজীপুরে মোট নিবন্ধিত ২,১৭৬টি কারখানার মধ্যে ৫৪টি বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছেÑ টিএমএস অ্যাপারেলস, নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ জিন্স, হার্ডি টু এক্সেল, পলিকন লিমিটেড, অ্যাপারেল প্লাস ও দি ডেল্টা নিট। গত ২৮ ফেব্রæয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর ও সারাবোতে অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৪টি ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ৩৩ হাজার ২৪৪ জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গত ৯ মাসে ২৩টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এতে প্রায় ৬ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। শিল্প পুলিশ-৪ এর তথ্য মতে, স¤প্রতি এই তিন জেলায় বন্ধ হওয়া কিছু কারখানা হলো গ্রিন বাংলা হোম টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এশিয়ান ফ্যালকন গার্মেন্টস, জিএল ফ্যাশন, মাস্টার টেক্সটাইল, স্টার কাটিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েস্ট বেস্ট অ্যাটায়ার্স ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠান ছোট ও মাঝারি আকারের এবং মূলত অর্থনৈতিক চাপে পড়েই তারা বন্ধ হয়েছে।
সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই শিল্প এলাকায় ১,৮৬৩টি কারখানার মধ্যে ৭৪৫টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এতে ১০,১২৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। শিল্প পুলিশ-১-এর তথ্য মতে, এ এলাকায় স¤প্রতি বন্ধ হওয়া কিছু কারখানা হলো জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, বেস্ট ওয়ান সোয়েটার, এমএস সোয়েটার, সাভার স্পোর্টসওয়্যার, বার্ডা গ্রæপ, র্যামস ফ্যাশন, প্রিয়াঙ্কা ফ্যাশন ও জাভান টেক্স নিটওয়্যার।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬১১টি, যার মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ৩৫০টি। দীর্ঘদিন ধরে ২৬১টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। চালু থাকা ৩৫০টি কারখানার মধ্যে ১৮০টি বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডারে কাজ করছে, বাকিগুলো সাব-কন্ট্রাক্টে চললেও অনেকের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমইএসহ বিভিন্ন সংস্থার আওতাভুক্ত পোশাক কারখানার সংখ্যা ৫৮০টি। এর মধ্যে ৫২৮টি চালু থাকলেও কাজের সংকটে গত ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে ৫২টি কারখানা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এক বছরের মধ্যে শুধু নিট পোশাক খাতে ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। আগামী তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে আরো কারখানা বন্ধ হবে। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছে। আমাদের আশপাশে আরো কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। যারা চাকরি হারাচ্ছে, তারা অপরাধমূলক কর্মকাÐে জড়াচ্ছে।
ট্রেড ইউনিয়নগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক সংকটের কারণে গত সাড়ে ৮ মাসে ১ লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের। নতুন কাজের অভাবে অনেকেই ঢাকায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। স্থায়ী আয় না থাকায় ঈদের খরচ মেটানো তো দূরের কথা, পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ চালানোও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, দেশের পোশাক খাতে প্রায় ৭৬টি কারখানা চলতি বছরই বন্ধ হয়েছে। ছয় মাসে ৫০টির বেশি বন্ধ হয়েছে। বন্ধ কারখানার ৫১ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। গ্যাস সংকট, উচ্চ সুদহার, এলসি জটিলতাসহ নানা কারণে ছোট ও মধ্যম কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে।
শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) শীর্ষ নেতা এবং সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, একটা শ্রমিকের চাকরি চলে যাওয়ার পর যখন বাসাভাড়া, বাজার করা বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে, ওই অঞ্চলে পড়ে। এতে শ্রমিকরা শুধু অর্থনীতির দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, মানবিকভাবেও বিপন্ন হয়ে পড়ে।