International

চীনের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ

ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার মধ্যেও পাকিস্তান এবার চীন ও আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে প্রায় চার বছর পর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আবার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শুরু হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিক হলেও তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জানিয়েছেন, বেইজিংয়ে হওয়া বৈঠকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আবার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ।

তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তান ও পাকিস্তান স্পষ্টভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং নীতিগতভাবে তারা যত দ্রুত সম্ভব পরস্পরের দেশে রাষ্ট্রদূত পাঠাতে রাজি হয়েছে। চীন এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা করবে।’ এই আলোচনা সম্পর্কে এক পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেন, ‘বেইজিং বৈঠকের ইতিবাচক ফলাফল ধরে রাখতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আবার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হবে।’ 

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যেই ত্রিপক্ষীয় বৈঠক

এই বৈঠকটি এমন সময় হলো, যখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ৭ থেকে ১০ মে পর্যন্ত টানা চারদিন ধরে সামরিক উত্তেজনা চলেছে। দুই দেশই নিজেদের ‘জয়ী’ দাবি করে এবং কূটনৈতিক লড়াইয়ে নামে। চীন দু’দেশকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন স্পষ্ট ছিল। পাকিস্তান এই সংঘাতে চীনের তৈরি জেট, ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির পাহেলগাঁও হামলার নিন্দা জানান। এমনকি মে মাসের শুরুতে তালেবানের একজন উচ্চপদস্থ নেতা ইব্রাহিম সদর দিল্লি সফর করেন।

আফগানিস্তানকে ঘিরে কৌশলগত পরিবর্তন

ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তান-চীন ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা হায়দার সৈয়দ বলেন, আফগানিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় বেইজিং বৈঠকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সংঘাত পাকিস্তান ও চীনকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এখন জরুরি।’কাবুলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক তামিম বাহিসও একমত পোষণ করে বলেন, ‘মুত্তাকি ও জয়শঙ্করের মধ্যে ফোনালাপ ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।’

সম্পর্কের টানাপড়েন

২০২১ সালের আগস্টে আফগান তালেবানরা যখন আবার ক্ষমতায় আসে, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন এটা পাকিস্তানের জন্য একটি বড় সাফল্য, কারণ পাকিস্তানের সাথে ঐতিহাসিকভাবে তালেবানদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ছিল তালেবানদের অন্যতম মিত্র। অপরদিকে, ভারত মনে করত তালেবান হলো পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হাতের পুতুল, তাই ভারত তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেনি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ও তালেবানের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। পাকিস্তান অভিযোগ করে, আফগান তালেবান তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান -এর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালাতে দিচ্ছে। তালেবান এ অভিযোগ অস্বীকার করে। 

পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পাকিস্তানে ৫২১টি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এসব হামলায় প্রায় ১,০০০ বেসামরিক ও নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয়েছেন। তবে সম্পর্কের এই খারাপ সময়ের মধ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ১৯ এপ্রিল কাবুল সফর, যেটিকে অনেকেই সম্ভাব্য অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন।

ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে হলে আগে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে সশস্ত্র সংঘাতে গড়াতে পারে।’ তার মতে, ‘চীন যেহেতু বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দু’দেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তাই চীনই হতে পারে মধ্যস্থতাকারী ও গ্যারান্টি প্রদানকারী।’

নিরাপত্তা ইস্যুতে যৌথ উদ্বেগ

পাকিস্তান বারবার বলছে, আফগান তালেবান তাদের দেশের বিরুদ্ধে হামলার জন্য সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। এই হামলাগুলোর অনেকগুলো হয়েছে চীনা নাগরিকদের ওপর, যারা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২০,০০০ চীনা নাগরিক পাকিস্তানে বসবাস করছেন। ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে অন্তত ২০ জন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। এসব হামলার দায় তালেবানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বীকার করেছে।

চীনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট নিয়ে। চীন অভিযোগ করে, এই গোষ্ঠীর সদস্যরাও আফগানিস্তান থেকে চীনের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। পাকিস্তান-চীন ইনস্টিটিউটের মুস্তাফা হায়দার সৈয়দ বলেন, ‘পাকিস্তান ও চীন—দুই দেশের জন্যই আফগানিস্তানে নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় বিষয়। কারণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আফগানিস্তানে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এই গোষ্ঠীগুলোকে ঠেকানো ছাড়া কোনো ধরনের সহযোগিতা টেকসই হবে না।’ তবে কাবুলভিত্তিক বিশ্লেষক তামিম বাহিস বলেন, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশ, এমনকি চীনও, আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে গ্রহণযোগ্য মনে করছে। তাই তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাপারে ব্যতিক্রম শুধু পাকিস্তান, যাদের ওপর এখনও আফগান ভূখণ্ড থেকে বড় ধরনের হুমকি আছে। পাকিস্তান যেখানে তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করতে চায়, সেখানে কাবুলের অগ্রাধিকার হচ্ছে বাণিজ্য, পরিবহন ও আঞ্চলিক সংযোগ।’

এই পরিস্থিতিতে চীন বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বাহিস। তিনি বলেন, চীন একদিকে নিরাপত্তায় সহযোগিতা বাড়াতে পারে, আবার অন্যদিকে এমন বাণিজ্য ও পরিবহন উদ্যোগ চালু করতে পারে, যা তিন দেশেরই উপকারে আসবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d online