USA

বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের ইনকুইজিশন!

মধ্যযুগে ইনকুইজিশন যেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো, ট্রাম্পের প্রশাসন তেমনি বিদেশি শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারির জাল বিছিয়েছে।

এক কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাজগতের উপর। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা স্বপ্নের ডানা মেলে পড়তে আসে, সেই শিক্ষাঙ্গন আজ এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ভিসা নীতি, যেন মধ্যযুগের খ্রিস্টান ইনকুইজিশনের মতো, বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রতিটি পোস্ট, প্রতিটি মতামত যাচাই করা হচ্ছে, যেন তারা কোনও অপরাধী! কেউ ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই ভিসা বাতিল, এমনকি আটকের হুমকি! তবে হার্ভার্ড নীরব নয়।

বিশ্বের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে হাত মিলিয়ে এই অন্ধকারে তারা আলোর পথ খুঁজছে। এটি কেবল নীতির লড়াই নয়, এটি জ্ঞানের, স্বপ্নের, আর মানবতার বিরুদ্ধে এক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

মধ্যযুগে ইনকুইজিশন যেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো, ট্রাম্পের প্রশাসন তেমনি বিদেশি শিক্ষার্থীদের উপর নজরদারির জাল বিছিয়েছে। হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি “অতিরিক্ত উদারপন্থী” এবং “ইহুদি-বিরোধী” মনোভাব পোষণ করে। এই অভিযোগের নামে হার্ভার্ডে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভিসা আবেদন পর্যালোচনা বন্ধ, সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পোস্ট খুঁজে বের করা, এমনকি গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদীদের ভিসা বাতিল ও আটক—এ যেন আধুনিক ইনকুইজিশনের এক ভয়ঙ্কর রূপ। গত সপ্তাহে এক মার্কিন বিচারক এই আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করলেও, শিক্ষার্থীদের মনে ভয়ের ছায়া কাটেনি।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি অ্যান্ড্রু জ্যাকের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা শুধু শিক্ষার্থীদের স্বপ্নই ভাঙছে না, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপরও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। প্রায় ১১ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী, যাদের বেশিরভাগ চীন ও ভারত থেকে, প্রতি বছর ৪৫০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসে। ট্রাম্পের “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন” মৌতাতে মগ্ন এই নীতি যেন সেই অর্থনৈতিক ভিত্তিকেই কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

হার্ভার্ড এই অন্ধকারে হাল ছাড়েনি। যেন মধ্যযুগের অন্ধকারের বিরুদ্ধে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর শপথ নিয়েছে তারা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিজনেস স্কুলের মতো নামী প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। লক্ষ্য? যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম ও শরৎ সেমেস্টারে হার্ভার্ডে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু ভিসার ফাঁদে আটকে পড়েছেন, তাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, আমরা পরিকল্পনা তৈরি করছি, যাতে আমাদের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও গবেষকরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। আইনি লড়াইয়েও হার্ভার্ড পিছপা নয়। গত সপ্তাহে তারা ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নতুন করে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে। মিনেসোটার ম্যাকালেস্টার কলেজের প্রেসিডেন্ট সুজান রিভেরা, যেখানে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর একজন বিদেশি, তিনি তার শিক্ষার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, এই নীতি শিক্ষার্থীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। যারা বৈধ ভিসা নিয়েও দেশে ফিরলে আবার হয়ত আমেরিকা ঢুকতে পারবেন না। তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারেন সে লক্ষ্যে আমরা ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করছি ।

নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, নর্থইস্টার্ন এবং হাল্ট ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদেশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জায়গা করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। কাতারে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠানো যেতে পারে। তবে এই পথ মসৃণ নয়। ভিন্ন দেশের ক্যাম্পাসে পড়াশোনার খরচ, একাডেমিক মান, এবং কোর্সের ক্রেডিট স্বীকৃতি নিয়ে জটিলতা রয়েছে। হাল্টের নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট মার্টিন বোয়েম এখনও আশাবাদী, আমি বিশ্বাস করি, সবকিছু ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু এই আশাবাদের মাঝেও শঙ্কার ছায়া।

হার্ভার্ডে ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদেশ থেকে আসেন। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন—গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে ফিরলে কি আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে পারবেন? এই ভয় শুধু হার্ভার্ডের নয়, গোটা মার্কিন দেশের বিদেশি শিক্ষার্থীদের মনে ছড়িয়েছে। ইটিএস-এর প্রধান অমিত সেভাক জানিয়েছেন, ইংরেজি ভাষা পরীক্ষার আবেদন দুই অঙ্কের হারে কমেছে। তিনি বলেন, “এই সেমেস্টারের আগেই কেউ কেউ আবেদন প্রত্যাহার করতে পারেন, বিলম্ব করতে পারেন, বা অন্য দেশে পড়তে চাইতে পারেন। ২০২৬ সালে এর বড় প্রভাব পড়বে।”

ফ্লোরিডার রলিন্স কলেজের প্রেসিডেন্ট গ্রান্ট কর্নওয়েল বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসেন না, তারা শ্রেণিকক্ষে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন, যা আমাদের শিক্ষার মিশনকে সমৃদ্ধ করে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভিসা নবায়নের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষার্থীদের এই দুশ্চিন্তা ভবিষ্যতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠন এনএএফএসএ ট্রাম্পের নীতিকে “অগ্রহণযোগ্য আক্রমণ” বলে সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, এই নীতি শিক্ষার্থীদের মনে ভয় আর অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ঘনিয়ে তুলছে। মধ্যযুগের ইনকুইজিশন যেমন জ্ঞান ও স্বাধীন চিন্তাকে দমন করতে চেয়েছিল, ট্রাম্পের নীতিও তেমনি শিক্ষার সীমান্তহীন চেতনাকে বন্দি করতে চাইছে। কিন্তু হার্ভার্ড, শিকাগো, লন্ডন—এইসব প্রতিষ্ঠান একযোগে লড়ছে। তারা নতুন পথ খুঁজছে, আইনি লড়াই চালাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

এই গল্প শুধু নীতি বা অর্থনীতির নয়। এটি সেই তরুণ-তরুণীর গল্প, যারা স্বপ্নের ডানায় ভর করে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এসেছে। হার্ভার্ড তাদের সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। কারণ শিক্ষা কেবল জ্ঞানের আলো নয়, এটি মানুষের মধ্যে সেতু বাঁধে, ভিন্নতাকে এক করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এই নিষেধাজ্ঞা শুধু শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা নয়, এটি জ্ঞানবিনিময়ের চেতনার উপর আঘাত। হার্ভার্ড ও তার সঙ্গীরা এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়ছে, যেন জ্ঞানের আলো কখনো নিভে না যায়। এবারে এক নতুন ভোরের অপেক্ষা, যেখানে শিক্ষার স্বাধীনতা আবারও জয়ী হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই অন্ধকার কি সত্যিই কাটবে, নাকি বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন আমেরিকার মাটিতে এবার থমকে যাবে?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto