Hot

স্বস্তির বাতাসে অস্বস্তি ছড়াচ্ছে কিছু চ্যালেঞ্জ

ইশরাকের অনড় অবস্থান * বিতর্কিত সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ বাতিলে ধীরগতি * এনবিআর গেজেট নিয়ে এখনো চাপা ক্ষোভ

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক রাজনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত করলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা পুরোপুরি কাটেনি।

সংস্কার ও বিচার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হলেও এ সরকারের সময়ে বিগত ১০ মাসে যেভাবে কাজ হওয়া দরকার ছিল, সেভাবে গতি পায়নি। বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের বোঝাপড়া হলেও জামায়াত ও এনসিপি কিছুটা দূরত্বে আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এছাড়া ভোটের রাজনীতি নিয়ে তাদের নিজস্ব এজেন্ডাও রয়েছে।

এদিকে লন্ডন বৈঠকে বেশ স্বস্তির আভাস মিললেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের আন্দোলন অস্বস্তি ছড়াচ্ছে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের শায়েস্তা করতে বিতর্কিত অধ্যাদেশ নিয়ে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। সচিবালয়ে কর্মচারী আন্দোলনের এমন দৃশ্য অতীতে কেউ দেখেনি। এনবিআর অধ্যাদেশ বিতর্কও রয়ে গেছে সেই তিমিরে।

আন্দোলন থামলেও বাড়ছে চাপা ক্ষোভ। পর্যবেক্ষক মহল বলছে, লন্ডন বৈঠকের ফসল ভালোভাবে ঘরে তুলতে হলে অবশিষ্ট এই চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুত দূর করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে প্রতিপক্ষরা আরও সক্রিয় হবে। এর ফলে লন্ডন বৈঠকের স্বস্তির পরিবেশ বেশিদিন ধরে রাখা কঠিন হবে।

১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।

প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।

তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।

বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘কিছু তো পলিটিক্যাল চ্যালেঞ্জ থাকবেই। এখন যে কথা বলা হচ্ছে, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন-সেক্ষেত্রে ছোটখাটো সংস্কার ছাড়া বড় সংস্কার নির্বাচিত সরকারের আমলেই হতে হবে। বিচার অনেক বিস্তৃত বিষয়। এই বিচার শেষ করতে কম করে হলেও পাঁচ বছর সময় লাগবে। ২/১টা বিচার বড়জোর করা সম্ভব। বিচারের কথা বলে তো নির্বাচন পাঁচ বছর বিলম্বিত করা যায় না। আর সবাই সব বিষয়ে একমত হবে এই বিষয়ে আমি একমত না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায়, তাহলে ওই সময়ে নির্বাচনে তেমন কোনো বাধা দেখছি না। বরং বেশির ভাগ দল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না চাইলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু এমন কোনো অবস্থা দেখতে পাচ্ছি না।’

শাহদীন মালিক বলেন, ‘স্বৈরাচার হটানো হয়েছে গণতন্ত্র আনার জন্য। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র আনা সম্ভব নয়। তাই আমি মনে করি, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।’

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, লন্ডনে বৈঠক সত্ত্বেও সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। লন্ডন বৈঠকের কারণে রাজনীতিতে আপাতত উত্তজনা প্রশমিত হয়েছে। সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে বৈঠকটির ফল কতটা কার্যকর হয়, সেটা নির্ভর করবে অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছে তার ওপর। ইতোমধ্যে জামায়াত ও এনসিপি ভালোভাবে নেয়নি। তাদের ভিন্ন এজেন্ডা আছে। তারা সহজভাবে নাও নিতে পারে। ফলে অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে আগামী দুই মাসে পরিস্থিতি কোনদিকে অগ্রসর হয় তার ওপর। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করাটা এত সহজ হবে না। এ সময়ে নির্বাচন করা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে ঐক্য থাকতে হবে। পাশাপাশি ত্যাগের মনোভাব রাখাও জরুরি। আমি যা চাই, সেই স্থানে স্থির থাকলে চলবে না। গিভ অ্যান্ড টেক থাকতে হবে। কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছাড় দেওয়ার মনোভাব থাকতে হবে। যার যা অবস্থান থাকুক-ত্যাগের মনোভাব থাকলে আবার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করাটা অসম্ভবও নয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার-এই দুইটা হওয়ার কথা সবাই বলছে। কিন্তু সংস্কারে মন্থরগতি দেখা যাচ্ছে। সংস্কারকাজে সরকারকে গতি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সরকারকে সহায়তা করতে হবে।

তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, বিচারের গতি একেবারেই মন্থর। এই বিচার যে কবে শেষ হবে কে জানে! সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, গুম ঠেকাতে স্থায়ী কমিশন হবে। এ বিষয়ে দিলারা চৌধুরী প্রশ্ন রাখেন, তাহলে এতদিন তারা কী করেছেন? কমিশন গঠন করা নিয়ে আগে কিছু করেছে বলে তো মনে হয় না। তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, এভাবে ধীরগতিতে চলতে থাকলে নির্বাচন ঝুলে যেতে পারে। ফলে সংস্কার ও বিচারে অনেক বেশি গতি বাড়াতে হবে। এ কাজে সরকারের দায়িত্ব বেশি।

এই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে বৈঠক হওয়া ইতিবাচক। তবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গতি না বাড়ালে সংকট কাটবে না। সংকট থেকেই যাবে।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বিশ্লেষক আশরাফ কায়সার অবশ্য মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও বিএনপির সামনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। লন্ডনে বৈঠকের পর যেভাবে যৌথ বিবৃতি এসেছে, সেটা আমাদের রাজনীতিতে নতুন। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সৌহার্দপূর্ণ আলোচনাও নতুন। এ কারণে কিছুটা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এ কারণে জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি ভিন্নমত দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক সমাজে এটা কোনো অবাক করা বিষয় নয়।

তিনি আরও বলেন, ‘লন্ডন বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরস্পরের প্রতি সম্মানের দিক ছিল। জামায়াতে ইসলামী নিজেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চেয়েছিল। সরকারও এতে রাজি হয়েছে। কার মাধ্যমে হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। আর বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইলেও সেখানে তো তারা ছাড় দিয়েছে।’

আশরাফ কায়সার বলেন, ‘বিএনপি গত ৮/৯ মাস তাদের উপযুক্ত সম্মান পায়নি বলে অভিযোগ আছে। ফলে দলটির অবস্থা বিবেচনায় তাদের যথাযথ সম্মান তারা পেতে পারে। সেই সম্মান পাওয়ায় রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরেছে। এসব মিলিয়ে আমি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles