Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
International

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে চীন কি জড়িয়ে পড়বে

পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সংঘাতে যেভাবে চীন পরোক্ষ সহায়তা দিয়েছে, ইরানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, ভূ-রাজনৈতিক দূরত্ব, পশ্চিমাদের বিরোধিতা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষার কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তেমন কিছু করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ইসরাইলের হামলা এবং গুরুত্বপূর্ণ ইরানি সামরিক নেতা ও বিজ্ঞানীদের হত্যার ফলে ইসরাইল-ইরান সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, এই সঙ্ঘাতে চীনের কোনো ভূমিকা থাকবে কিনা, কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে চীনা অস্ত্র দেখা যাবে কিনা। ঠিক যেমন সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে দেখা গিয়েছিল।

যখন ভারত পাকিস্তানের ওপর হামলা চালায়, চীন তখন তার স্বাভাবিক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখে এবং দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। বেইজিং জানায়, পাকিস্তান ও ভারত তাদের প্রতিবেশী এবং চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। তারা উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে এমন যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানায়।

তবে উত্তেজনার মধ্যেই জানা যায়, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে চীনা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। অনেকেই মনে করেন, চীনা সেন্সর, যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তান ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। এতে বোঝা যায়, চীনা প্রযুক্তি ও অস্ত্র অনেক আধুনিক, যা ভারতের মতো পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর চেয়েও অনেক উন্নত।

চীনের সাথে ইরানেরও ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। বহু পশ্চিমা গবেষণা প্রতিষ্ঠান মনে করে, ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক উন্নয়নে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে ইরানের সাথে চীনের সম্পর্ক পাকিস্তানের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। ইরানের হাতে চীনা অস্ত্রের পরিমাণও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম। তাই পাকিস্তানের পরিস্থিতির সাথে ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করা সঠিক নয়।

চীন ও ইরান উভয়েই প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী এবং তারা নিজেদের পরিচয় ও অবস্থান গঠনে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়। তারা পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতি বিরক্তিও ভাগ করে নেয়। উনিশ শতকে রাশিয়া ও ব্রিটেন মিলে ইরানকে প্রভাব বলয়ে ভাগ করে নেয়। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। একইভাবে চীনও দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে এবং ‘শতাব্দীর অপমান’ সহ্য করে।

বিপ্লব-পূর্ব সময়ে আমেরিকার চাপে ইরান চীনের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। তবে সোভিয়েত প্রভাবের কারণে দুই দেশ কিছুটা কাছাকাছি আসে। চীনা নেতা হুয়া গুওফেং শাহের পতনের আগে তাকে দেখা শেষ বিদেশী নেতা ছিলেন। এই কারণে আয়াতুল্লাহ খোমেনি চীনকে শোষণকারী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন দিন পরেই চীন নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

চীন ধীরে ধীরে কূটনৈতিকভাবে ইরানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে, বিশেষ করে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়। তখন চীন গোপনে উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের মাধ্যমে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করে। এই অস্ত্রের মধ্যে ছিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও জাহাজ ধ্বংসকারী সিল্কওয়ার্ম ক্ষেপণাস্ত্র, যা ইরান ১৯৮৭ সালে ট্যাঙ্কার যুদ্ধের সময় ব্যবহার করে। এরপর আমেরিকা চীনের ওপর চাপ দেয় যেন তারা এসব অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে।

পরবর্তীতে চীন সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র না দিয়ে ইরানের নিজস্ব সামরিক শিল্পকে উন্নত করতে সহায়তা করে। ইরানের বহু ক্ষেপণাস্ত্র যেমন ওঘাব, নাজে’আত, শাহাব ও নাসর চীনা প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি। র‍্যান্ড কর্পোরেশনের মতে, চীন ইরানকে উন্নত নৌ-মাইন ও দ্রুতগতির আক্রমণকারী নৌকা সরবরাহ করেছে। যদিও ইরানে চীনা অস্ত্র বিক্রির সঠিক মূল্য নির্ধারণ কঠিন। তবে র‍্যান্ডের হিসাব অনুযায়ী তা ৪ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে হতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে চীনের ভূমিকা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে চীন ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ দেয়। ইসফাহানে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র গঠনে চীনের বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসরাইল এই কেন্দ্রের ওপর সাম্প্রতিক হামলা চালিয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে চীন যখন তেল আমদানিকারক দেশে রূপান্তরিত হয়, তখন ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ইরানি তেল চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে, আর ইরান তার সামরিক ও কূটনৈতিক চাহিদা পূরণে চীনকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে। বিশেষ করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলতে ইরানের জন্য চীনের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

তবে ইরান-চীন মৈত্রীর পথ সবসময় মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে পারস্পরিক সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৭ সালে তাইওয়ান প্রণালী সঙ্কটের পর চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে, তখন তারা ইরানকে সরাসরি পারমাণবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। এই সিদ্ধান্ত ইরানের সাথে বড় একটি ফাটল সৃষ্টি করে। যদিও চীনের পূর্ববর্তী সহায়তায় ইরান এমন জ্ঞান ও প্রযুক্তি অর্জন করেছিল, যা দিয়ে তারা নিজেরাই পরবর্তীতে পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

২০০০ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের অন্তর্ভুক্তির ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছুটা মুক্তি পায় তারা। এতে করে চীনা কোম্পানিগুলো তেহরানে বিশেষ করে জ্বালানি খাতে আরো বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (সিএনপিসি) সহায়ক কোম্পানির মাধ্যমে ইরানি বাজারে সক্রিয় অবস্থান নেয়। ২০০৭ সালে তারা কিশ গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, যা ইরানের জ্বালানি খাতে তাদের প্রভাব সুসংহত করার কৌশল হিসেবে দেখা হয়।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইরান দক্ষিণ আজাদেগান তেলক্ষেত্র উন্নয়নে সিএনপিসির সাথে চুক্তি করে। একই বছরে কোম্পানিটি সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত ইরানি অয়েল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কোম্পানির (এনআইসিও) বড় অংশীদার হয়ে ওঠে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। ক্রমে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ২০০৭ সাল থেকে চীন ইরানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে।

তবে নিষেধাজ্ঞা ও ভূ-রাজনৈতিক চাপের ফলে চীনা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক চীনা প্রতিষ্ঠান ইরানের জ্বালানি প্রকল্প থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। যেমন এনআইসিও দক্ষিণ আজাদেগান প্রকল্পের নির্ধারিত সময়সীমা পূরণে ব্যর্থ হয়, ১৮৫টি পরিকল্পিত কূপের মধ্যে মাত্র সাতটি খনন করে। ফলে ইরানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে চুক্তিটি বাতিল করে। ২০১৬ সালে পুনরায় আলোচনা শুরু হলেও তা ব্যর্থ হয়।

চীনা কোম্পানিগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার নজির এটিই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে পেট্রোচায়না এলএনজি পরিবহন প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হলেও পরে তা স্থগিত করে। কিশ দ্বীপে চীনা কোম্পানিগুলো গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করলেও প্রকল্পে বাস্তবায়ন অগ্রগতি হয়নি। ২০১৮ সালে সিএনপিসি দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১১তম পর্যায়ে টোটালের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করলেও পরে নিষেধাজ্ঞার চাপে তারা সেখান থেকেও সরে দাঁড়ায়।

২০২১ সালে বেইজিং ও তেহরান একটি ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার আওতায় চীন আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানো তথ্য অনুযায়ী তেল, গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি, বন্দর, রেলপথ ও সামরিক প্রযুক্তিতে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিনিময়ে তারা অগ্রাধিকারমূলক মূল্যে তেল কেনার সুবিধা ও চীনা পণ্যের বিনিময়ে মূল্য পরিশোধের সুযোগ পায়। কিন্তু বাস্তবে চীনা কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ ঘোষণা করেনি। বরং নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক ঝুঁকির কারণে তারা সতর্ক আচরণ করছে।

চীনের এই মনোভাব ইঙ্গিত দেয় যে প্রতীকী কৌশলগত সম্পর্কের ঘোষণা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও ভূ-রাজনৈতিক চাপ ইরানের জ্বালানি খাতে চীনের অংশগ্রহণ সীমিত করে রেখেছে। এর ফলে চীনা কোম্পানিগুলো তেহরানের চেয়ে বেইজিংয়ের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে চীনের অংশগ্রহণ তাদের কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ ছিল। একদিকে তারা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দাবিদার হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল, অন্যদিকে এমন কাঠামো চেয়েছিল যেখানে ব্যর্থতার দায় এককভাবে তাদের ওপর পড়বে না। চীনের পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত একতরফা মধ্যস্থতা থেকে বিরত থাকে।

চীন-আমেরিকা প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে ইরান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিষেধাজ্ঞামুক্ত জ্বালানি সরবরাহ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে ইরান চীনের কৌশলগত অংশীদার হয়। এই কারণেই চীনের পক্ষ থেকে ইরানের উপর সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পক্ষে জোরালো অবস্থান দেখা যায়।

চীনের নীতিগত অবস্থান হলো, তারা পারমাণবিক অস্ত্রপ্রসার রোধ করে। তবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের রাষ্ট্রীয় অধিকারকে সমর্থন করে, যদি তা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই অবস্থান চীনকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি পরিমিত, কৌশলগত ও কূটনৈতিক ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।

চূড়ান্ত বিষয়টি চীনের পারমাণবিক বিস্তার সংক্রান্ত নীতিগত অবস্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট। বেইজিং সুপরিচিতভাবে ইরানসহ যেকোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরোধিতা করে। তবে এটি পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়, যদি তা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই নীতির আলোকে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চীন আইএইএ-কে ইরানে পরিদর্শন মিসনের জন্য ৪ মিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৫ লাখ মার্কিন ডলার) প্রদান করে। ফলে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসে, তখন চীন তা ‘অযৌক্তিক ও অর্থহীন’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করে এবং ওয়াশিংটনের চাপের মুখে অন্য দেশগুলোকেও চুক্তি থেকে সরে যেতে বাধ্য করার কৌশলকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি অভিযোগ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু নিজেই চুক্তি ত্যাগ করেনি। বরং অন্যদেরও নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে তা করতে বাধ্য করেছে।

এই বিরোধ পরিস্থিতি ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সামগ্রিক উত্তেজনার অংশ ছিল, যার মধ্যে তাইওয়ান ও বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বৈরিতা চীনকে ইরানের পারমাণবিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিপরীতে অবস্থান নিতে অনুপ্রাণিত করে। ফলে ইরানের পাশে থাকা চীনের কোনো বিশেষ ভালোবাসার কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যকে মোকাবেলার কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

চীনা কৌশলের কেন্দ্রে থাকা আরেকটি দিক হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় ইরানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব। ইরান শুধু জ্বালানি উৎস হিসেবে নয়, বরং চীন ও ইউরোপের মধ্যকার সরাসরি স্থল ও রেল রুটের সংযোগকারী একটি কেন্দ্রবিন্দু, বিশেষ করে সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্টের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ইরানের ভূগোল, জ্বালানি সম্পদ এবং উন্নত লজিস্টিক্স সুবিধা সব মিলিয়ে বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে এটি অপরিহার্য। সুতরাং ইরানে যুদ্ধ এবং পশ্চিমা হস্তক্ষেপ চীনের ইউরেশীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করে। কারণ, এই অঞ্চলে ইরানি ভূখণ্ডকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনো কার্যকর স্থল বিকল্প নেই, যা কৌশলগত ও লজিস্টিক ব্যয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি না করে ইউরোপ পর্যন্ত চীনা পণ্য পরিবহণ নিশ্চিত করতে পারে। ফলে সঙ্ঘাতের ফলে রুট ব্যাহত হলে চীনের ইউরোপমুখী রফতানি ও রেল যোগাযোগে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এই প্রেক্ষাপটে চীনের রাজনৈতিক অবস্থান আরো শক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানের তুলনায় ইরানের ক্ষেত্রেই বরং চীন অপেক্ষাকৃত উচ্চস্বরে কথা বলছে, বিশেষ করে যখন এটি বেইজিংয়ের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করছে। তবে বাস্তবতা হলো, চীনের এই সমর্থন ইরানের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সরাসরি সামরিক সহযোগিতায় রূপ নেবে- এমন সম্ভাবনা খুবই কম। পিএল-১৫-এর মতো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র বা সরাসরি সামরিক প্রযুক্তি চীন ইরানকে দেবে, এমন জল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে দেখা যায়, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ এবং ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব সংঘটিত হয় চীনের সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে, যা সরাসরি চীনের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। তদ্ব্যতীত, ভারত চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সীমান্তসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বের অংশ। পক্ষান্তরে, ইসরায়েল চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, পাকিস্তান কোনো পশ্চিমা প্রতিপক্ষ নয় এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই; ফলে ইসলামাবাদের প্রতি সমর্থন দেয়ার রাজনৈতিক খরচ কম। অন্যদিকে, ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা একটি রাষ্ট্র, যার সমর্থনে সরাসরি অংশগ্রহণ মানে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, যা চীন এখনো এড়িয়ে চলতে চায়।

এছাড়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় চীন সরাসরি জড়িত ছিল না এবং পাকিস্তান যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছিল তার বেশিরভাগই পূর্বে চীন থেকে আমদানি করা। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-র মতে, পাকিস্তানের অস্ত্র আমদানির ৮১ শতাংশ আসে চীন থেকে, যা চীনের মোট অস্ত্র রফতানির ৬৩ শতাংশেরও বেশি। সেই অস্ত্রসম্ভার যুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানের কাছে মজুদ ছিল। সুতরাং এসব বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে বলা যায়, চীন ইরানের পাশে নীতিগত ও কূটনৈতিকভাবে দাঁড়ালেও সরাসরি সামরিক সহযোগিতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। তেহরানের নয়, বরং বেইজিংয়ের স্বার্থকে কেন্দ্র করে তার প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করা হচ্ছে।

গত এক দশকে ইরানে চীনা অস্ত্র আমদানির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে রাশিয়া ছিল ইরানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী এবং ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালেও রাশিয়াই ছিল তেহরানের একমাত্র উল্লেখযোগ্য সরবরাহকারী। সেই প্রেক্ষিতে চীনা অস্ত্র আমদানি উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর তুলনায় অনেক সীমিত ছিল।

এর বিপরীতে, পাকিস্তান যেখানে গত পাঁচ বছরে তার ৮১ শতাংশ অস্ত্রই চীন থেকে আমদানি করেছে, সেখানে ইরানের সামরিক সক্ষমতা অনেকটা স্থানীয় উদ্ভাবন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রযুক্তিগত বিকাশের উপর নির্ভরশীল। ইরানের বিমান বাহিনী তুলনামূলকভাবে পুরনো। দেশটি মূলত নিজের পারমাণবিক কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র এবং হালকা নৌযান তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। এসব ক্ষেত্রেও চীন মাঝে মাঝে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে।

এই ব্যবধানের মূল কারণ নিষেধাজ্ঞা। মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলোর ফলে চীন-ইরান সামরিক লেনদেন অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ে। তবে তা দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করেনি। ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচবার চীন ও ইরান যৌথ নৌ মহড়া পরিচালনা করেছে, যা একটি প্রতীকী কিন্তু টেকসই সামরিক যোগাযোগের ইঙ্গিত দেয়।

ইসরাইলের সাম্প্রতিক ইরান আক্রমণ শুরু হওয়ার পর চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল তার প্রচলিত কূটনৈতিক ধারা অনুযায়ী সীমিত ও সাবধানী। চীন আঞ্চলিক সঙ্কট মোকাবেলায় সর্বদা একটি মধ্যপন্থী পন্থা গ্রহণ করে- পক্ষগুলোকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান, জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান এবং বহুপাক্ষিক কাঠামোর মাধ্যমে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির ওপর জোর।

আক্রমণের একদিন আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান ইঙ্গিত দেন, বেইজিং পারমাণবিক সঙ্কটের রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। যুদ্ধ শুরুর পরও তিনি ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলিকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানান।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকেও চীনের রাষ্ট্রদূত ফু কং ‘ইসরাইলি সামরিক দুঃসাহসিকতা’ বন্ধের আহ্বান জানালেও বেইজিং যে সরাসরি কূটনৈতিক কাঠামোর বাইরে কোনো একতরফা ভূমিকা নেবে না, তাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে ইরানের মতো মার্কিন শত্রুদের প্রতি চীনের এই ‘বিচক্ষণতা’ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। বেইজিং যেভাবে নিজেদের একটি বিকল্প বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তা তখনই বাস্তব রূপ পাবে যখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া হস্তক্ষেপ বা দমননীতি থেকে নির্যাতিত দেশগুলোর জন্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়বে।

কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে চীনের ভূমিকা অনেকের কাছে দুর্বল ও সিদ্ধান্তহীন মনে হচ্ছে। এটি এমন একটি সময়ে ঘটছে যখন বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশ – যাদের চীন নেতৃত্ব দিতে চায় – পশ্চিমা আধিপত্য থেকে বেরিয়ে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী। তাদের চোখে বেইজিংয়ের এই ‘কূটনৈতিক পলায়ন’ আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্বিন্যাসে নেতিবাচক বার্তা প্রেরণ করতে পারে।

সবশেষে, যদিও চীন পারমাণবিক চুক্তির রাজনৈতিক রক্ষাকবচ হিসেবে ইরানের পক্ষে দাঁড়ায়, তবে ইসরাইল-ইরান যুদ্ধের ক্ষেত্রে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ বা কার্যকর রণকৌশল অবলম্বনের কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সংঘাতে যেভাবে চীন পরোক্ষ সহায়তা দিয়েছে, ইরানের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, ভূ-রাজনৈতিক দূরত্ব, পশ্চিমাদের বিরোধিতা এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের স্থিতিশীলতা রক্ষার কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে তেমন কিছু করার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacantoto4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d toto
slot toto
bacan4d
bacan4d
togel online
Toto Slot
saraslot88
Bacan4d Login
bacantoto
Bacan4d Login
bacan4d
bacan4drtp
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot maxwin
slot bacan4d
slot maxwin
bacan4d togel
bacan4d login
bacan4d login
bacan4d login
bacantoto 4d
slot gacor
bacansport
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot77 gacor
JAVHD
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
gacor slot
slot gacor777
slot gacor bacan4d
bacan4d
bacansport
toto gacor
bacan4d
bacansports login
slot maxwin
slot dana
slot gacor
slot dana
slot gacor
bacansports
bacansport
bacansport
bacansport
bawan4d
bacansports
bacansport
slot gacor
judi bola
slot maxwin
slot maxwin
bacansport
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot demo
slot gacor
slot gacor
slot gacor
toto slot
slot gacor
demo slot gacor
slot maxwin
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot toto