Trending

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সামুদ্রিক ঘাসের নিঃশব্দ সংগ্রাম

তাহলে এই সামুদ্রিক ঘাসই কি পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকা উদ্ভিদ, যা আমাদের সবাইকে বাঁচতে সহায়তা করে? সেটি আগামীর সময়ই বলে দেবে।

জন এফ কেনেডির একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তা হলো, ‘আমরা সমুদ্রবান্ধব মানুষ। সেজন্য আমরা যখন সমুদ্রে যাই, মনে হয়, আপন নীড়েই ফিরে এসেছি।’ এই উক্তিটি আপনার ধারণার চেয়েও বেশি মর্মস্পর্শী। আমরা সমুদ্রের সাথে উতপোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর সকল জীবন এর গভীরতা থেকেই উৎসারিত। এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ

বিশালকার মহাসাগরগুলো পাঁচটি অববাহিকায় প্রবাহিত। তা হলো, আর্কটিক, আটলান্টিক, ইন্ডিয়ান, প্যাসিফিক ও সাউদার্ন। এ মহাসাগরগুলো বিশ্বের প্রায় ৭১ শতাংশ জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এসব মহাসাগর আমাদের জীবিত রাখার প্রক্রিয়াগুলোতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

Ocean

রেইনফরেস্টকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে আসলে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ সরবরাহ করে সাগর-মহাসাগর। এরপর একটি কনভয় বেল্টের মাধ্যমে পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং বিষুবরেখা থেকে মেরুতে তাপ স্থানান্তর করে পরিবেশ শান্ত রাখে। এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সমুদ্র নিজেকে অপরিহার্য বলে প্রমাণিত করে। এটি আমাদের বায়ুমণ্ডলের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। অথবা বলা যায়, এটি সমুদ্র নিজেই নয় … বরং এতে যা বাস করে তা-ই শোষণ করে।

অনেক ধরণের জলজ প্রাণী প্রাকৃতিকভাবে কার্বন শোষণ করে এবং ধরে রাখে। এরপর তারা সমুদ্রতলের নিচে নেমে আসে এবং সেখানেই তা রেখে দেয় মৃত্যু পর্যন্ত। মাইক্রোস্কোপিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন থেকে শুরু করে বিশাল তিমি পর্যন্ত, সকল আকারের প্রাণী এই ‘কার্বন সিঙ্ক’ শোষণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। এরা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করার চেয়ে বেশি শোষণ করে। সম্ভবত সবচেয়ে অবিশ্বাস্য রূপগুলোর মধ্যে একটি হলো সামুদ্রিক ঘাস।

সমুদ্র ঘাস

বিশ্বজুড়ে ৭০টিরও বেশি প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস রয়েছে। সেগুলো অগভীর এবং আশ্রয়প্রাপ্ত উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মায়। এটি ছয়টি মহাদেশের ১৫৯টি দেশের বিশাল পানির নিচের তৃণভূমিতে জন্মায়। ওই ভূমি ৩ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে (১১৫,০০০ বর্গমাইল) বিস্তৃত। এটি ইতালির সমপরিমাণ একটি এলাকা হতে পারে। তবে এটি সমুদ্রতলের মাত্র ০.২ শতাংশ অঞ্চল। আর এখানেই সুপার সিগ্রাস তার নিজস্বতা অর্জন করে। কারণ এটি প্রতি বছর সমুদ্রের কার্বনের ১০ শতাংশ শোষণ করে এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্টের তুলনায় ৩৫ গুণ দ্রুত কার্বন ধারণ করে।Ocean-Grass2

সিগ্রাস কার্বন ব্যবহার করে তার পাতা এবং শিকড় তৈরি করে, যা এটি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি থেকে আহরণ করে এবং মৃত্যুর পরেও এটি কার্বনকে ধরে রাখে। মৃত উদ্ভিদ উপাদান সমুদ্রের তলদেশে ধীরে ধীরে পচে যায়। অবশেষে এর মধ্যে সঞ্চিত কার্বন সমুদ্রতলের নীচে চাপা পড়ে।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে জলবায়ু পরিবর্তনের এত কার্যকর প্রাকৃতিক উপায় নিজেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে। কারণ, এতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পরে ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড়ে এই ঘাস সমুলে উৎপাটিত হয়ে যায়। দূষণ, উপকূলরেখার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন এবং অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা এই সবকিছুই এই সামুদ্রিক ঘাস ধ্বংসে ভূমিকা পালন করে।Ocean-Grass3

জাতিসঙ্ঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউনেপ) অনুসারে, বিশ্বজুড়ে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ সিগ্রাস এলাকা ধ্বংস করা হয়। বিশ্বব্যাপী, এটি প্রতি বছর প্রায় ৭ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। গত শতাব্দীতে যুক্তরাজ্য তার ৯০ শতাংশেরও বেশি সামুদ্রিক ঘাস হারিয়েছে।

সামুদ্রিক ঘাস অত্যন্ত বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এটি এখন ইইউর বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের তালিকায় রয়েছে। যদি এর বিলুপ্তিরোধে ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে কিছু সামুদ্রিক ঘাস বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

পোসিডোনিয়া ওশেনিকা

সামুদ্রিক ঘাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হলো পোসিডোনিয়া ওশেনিকা। এটি সমুদ্রের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী উদ্ভিদগুলোর মধ্যে একটি। সমগ্র ভূমধ্যসাগরে এই ঘাসটি পাওয়া যায়। এটি বিশেষভাবে মাইক্রোবিয়াল অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অর্থাৎ যখন এই ঘাসটি মারা যায় এবং সমুদ্রের তলদেশে পঁচে যায় তখন এর ভেতরে আটকে থাকা কার্বন আর নিঃসারিত হয় না।Ocean-Grass5

দুই দশক আগে ম্যালোর্কা এবং ফর্মেন্তেরার মধ্যে ৫৫ হাজার হেক্টর সামুদ্রিক ঘাস এলাকাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে মনোনীত করেছিল। পোসিডোনিয়া ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০০০ সাল থেকে গ্রীষ্মের অর্ধেক এই ‘তাপীয় সীমা’ অতিক্রম করেছে। নৌকা নোঙর ফেলে দিলে পোসিডোনিয়াও ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে মাত্র চার বছরে ফর্মেন্তেরার তৃণভূমিতে ৪৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত উদ্ভিদটি খুব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়; একদিনে মাত্র একটি নোঙরের ক্ষতি পুনরুদ্ধার করতে ১ হাজার বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

কী করা যেতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সামুদ্রিক ঘাসের হ্রাস ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। আশার কথা হলো, কেনিয়া, মোজাম্বিক এবং যুক্তরাজ্যের মতো দূরবর্তী স্থানে পুনরুদ্ধার অভিযান ইতিমধ্যেই চলছে।

গত শতাব্দীতে ডেনমার্ক তার মোহনা এবং খাঁড়িতে ৯৫ শতাংশ সামুদ্রিক ঘাসের ক্ষতি করেছে। সেখানে ঘাস পুনরুদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রিড প্যাটার্নে এক মিটার বর্গক্ষেত্রে পুনরায় মোট ৪০ হাজারেরও বেশি অঙ্কুর রোপণ করা হয়েছে।

২০২০ সালে ওয়েলসের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিগ্রাস ওশান রেসকিউ টিমও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের একটি দল পেমব্রোকশায়ার উপকূলে ডেল বেতে দুই হেক্টর জমিতে দশ লাখ বীজ রোপণ করেছিল।

যুক্তরাজ্যের অন্যত্র ওশান কনজারভেশন ট্রাস্ট (ওসিটি) একটি সিগ্রাস চাষ ল্যাব খুলেছে। এখানে সিগ্রাস বিভিন্নভাবে চাষ করা হয়। ডুবুরিদের হাতে বাছাই করা বীজ-বহনকারী অঙ্কুর ব্যবহার করা হয়। এটি কোনো ছোট কাজ ছিল না। অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ৭ লাখ বীজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ১৭ হাজার ৫০০ অঙ্কুর সংগ্রহ করতে হয়েছিল। ২০২১ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ সাউন্ডের সমুদ্রতলদেশে এই চারাগুলোর ২,২০০ ব্যাগ রোপণ করা হয়েছিল। আশা করা হচ্ছে যে এগুলো একটি বিশাল তৃণভূমিতে অথবা ছয়টি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ জায়গায় বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন উদ্ভিদগুলোকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য নাবিকদের দূরে থাকতে বলা হয়েছে। এটি একটি চার বছরের প্রকল্পের সূচনা। এর পরের লাইনে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল এবং আইল অফ ওয়াইটের মধ্যে সমুদ্রের একটি অংশ রয়েছে।

এদিকে, বেলেরিক পর্বতমালার রৌদ্রোজ্জ্বল জলবায়ুতে এই প্রাণবন্ত সবুজ উদ্ভিদের বিস্ময় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ‘পোসিডোনিয়া উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোসিডোনিয়া রক্ষার জন্য সরকারি পদক্ষেপও জোরালো হয়েছে। তবে গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে পোসিডোনিয়ার ভেতরে আটকে থাকা কার্বনের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা গেলে তহবিল বৃদ্ধি পেতে পারে, যা এটিকে রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহার করা যাবে।

এটি ইতোমধ্যে কেনিয়ার গাজি উপসাগরে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে তাদের সামুদ্রিক ঘাস প্রকল্পটি এই ‘কার্বন ক্রেডিট’ বিক্রির মাধ্যমে আংশিকভাবে অর্থায়ন করা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কারণ একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই সামুদ্রিক ঘাসগুলো অন্যত্র সামুদ্রিক ঘাস তৃণভূমির তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি কার্বন ধারণ করে, যা তাদের অতি-দক্ষ করে তোলে।

এই ধরণের পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ অনুমান করা হচ্ছে যে মাত্র এক হেক্টর পুনরুদ্ধার করা সামুদ্রিক ঘাস ভূমিতে ১০ হেক্টর বনের সমান কার্বন শোষণ করবে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এখনো দ্বিগুণ হুমকি। সামুদ্রিক ঝড়ের বৃদ্ধি অগভীর-শিকড়যুক্ত ঘাসকে তার মূল থেকে উপড়ে ফেলে।

যাইহোক, সামুদ্রিক ঘাস বেঁচে থাকার জন্য অভিযোজিত হয় বলে জানা যায়। জোস্টেরা মেরিনা সামুদ্রিক ঘাসগুলোর জিন সিকোয়েন্সিং দেখিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনটি পৃথক অনুষ্ঠানে তা দেখানো হয়েছে। তাহলে এই সামুদ্রিক ঘাসই কি পৃথিবীর দীর্ঘমেয়াদে বেঁচে থাকা উদ্ভিদ, যা আমাদের সবাইকে বাঁচাবে? সেটি আগামীর সময়ই বলে দেবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto