Hot

‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের ‘ঝুঁকি’

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন ৮ই আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং গণ-আন্দোলন চলাকালে রংপুরে পুলিশের গুলিতে রোকেয়া বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের নিহত হওয়ার দিন ১৬ই জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ ঘোষণা করেছে সরকার। এ ছাড়া, ৫ই আগস্টকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। গত ২৫শে জুন বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সংক্রান্ত পৃথক পরিপত্র প্রকাশ করেছে।

রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়ন ও চিরঞ্জীব করার প্রয়োজনে ৩৬ জুলাইয়ের প্রতিটি দিনকে শ্রদ্ধা-সম্মান বা ভবিষ্যতের অঙ্গীকারের নিদর্শনস্বরূপ পালন করাই হবে আমাদের নৈতিক কর্তব্য। ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার একটি ঐতিহাসিক রূপান্তরের স্মারক চিহ্নিত করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে দিবসের জন্য এই নাম রাষ্ট্রের পরিচয়ের ধারাবাহিকতা ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার সঙ্গে কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?
‘বাংলাদেশ’ নামটি অবিভাজ্য। এর পূর্বে বা পরে কোনো বিশেষণ বা রাজনৈতিক অভিধা যুক্ত করা সাংবিধানিক, ঐতিহাসিক ও নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। ‘নতুন বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি এমন একটি বিভ্রান্তিকর বার্তা দিতে পারে যেন পূর্ববর্তী রাষ্ট্র-পরিচয় বাতিল হয়ে গেছে এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন রাষ্ট্রসত্তা তৈরি হয়েছে। অথচ বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। সরকার পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমা, জনগণ ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃত্ব অটুট রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ শিরোনামে একটি দিবস ঘোষণার অর্থ বাস্তবিক অর্থে একটি বিকল্প রাষ্ট্রপরিচয় চালু করা। কারণ, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ‘এক’ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নাম ‘বাংলাদেশ’, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে  পরিচিত হইবে। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও দেয়নি এবং হয়নি।  যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি গণজাগরণ ও গণপ্রতিরোধের ফসল। কিন্তু এটিকে ‘নতুন রাষ্ট্রের সূচনা’ হিসেবে দেখা কতোটুকু যৌক্তিক? ইতিহাসে যেমন-১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তেমনিভাবে ২০২৪ সালে তা হয়নি। এখানে শাসনব্যবস্থা পাল্টেছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সত্তা পাল্টায়নি। বাংলাদেশ জনগণের রক্তে অর্জিত রাষ্ট্র। তার নাম, পতাকা, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ সবকিছুই একটি গভীর সামাজিক ও সাংবিধানিক চুক্তির প্রতিফলন। এইসব মৌলিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে সরকার যদি রাষ্ট্রের নামে রাজনৈতিক অভিধা সংযোজন করে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’  ঘোষণা করে, তবে তা রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় ও সংবিধানের মধ্যে এক বিপজ্জনক সংঘাতের জন্ম দেবে। রাষ্ট্রের নাম বা পরিচয়ে বিভ্রান্তি হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ সরকার নিতে পারে না।

জনগণ বারবার রক্ত দিয়ে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উচ্ছেদে নতুন বন্দোবস্ত বা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চেয়েছে, তা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নতুন আরেকটা রাষ্ট্রের মাঝে নয়।

রাষ্ট্রের নাম কেবল একটি টেক্সট নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক চেতনা ও পরিচয়ের নিদর্শন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Imagined Communities’-এ বলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে একটি কল্পিত সমপ্রদায়, যার অস্তিত্ব টিকে থাকে অভিন্ন নাম, ইতিহাস ও ভাষার ভিত্তিতে। বদলানো মানে হলো জনগণের আত্মপরিচয়ের পুনঃনির্মাণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধানের মৌল কাঠামো নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় রয়েছে। ১৯৮৯ সালের Anwar Hossain Chowdhury—Gi Bangladesh মামলায় আদালত বলেন, ‘সংবিধানের মৌল কাঠামো ধ্বংস করা যাবে না, এমনকি সংশোধনের মাধ্যমেও নয়।’ রাষ্ট্র হলো একটি ভৌগোলিক সীমারেখা (Territory), জনগণ (People) এবং সার্বভৌম কর্তৃত্ব (Sovereignty)।
রাষ্ট্র একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সত্তা। রাষ্ট্রের গভীরতম ভিত্তি হলো আত্মপরিচয়। 

অন্যদিকে সরকার (Government) হলো রাষ্ট্রের অস্থায়ী রাজনৈতিক অভিব্যক্তি। যার কাজ হলো সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
সরকার আসে এবং যায় কিন্তু রাষ্ট্র রয়ে যায়। সরকার কখনোই রাষ্ট্রের বিকল্প নয়, সরকার একটি অধ্যায় আর রাষ্ট্র একটি গ্রন্থ। সুতরাং ‘বাংলাদেশ’ কেবল একটি ভূখণ্ডের নামই নয়, এটি রক্তের মাধ্যমে উত্থিত একটি ইতিহাসের গভীরতম উচ্চারণ। অতএব, আগে-পরে কোনো বিশেষণ সংযুক্ত করে একে বিভ্রান্তিতে ফেলা যাবে না।

বিভ্রান্তির ফলাফল:
‘নতুন বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধ আপাতভাবে আশাবাদের প্রতীক হলেও বাস্তবে তা ধারণাগত বিভ্রান্তি ও সাংবিধানিক সংঘাতের সূচনা করতে পারে।
কোনো দিবস ঘোষণার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন, নতুন রাষ্ট্র কাঠামো কিংবা পূর্বতন রাষ্ট্র থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এক নতুন সত্তা এমন বার্তা জনমানসে প্রতিফলিত হলে, তা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে জাতীয় বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ একটি নিরবচ্ছিন্ন জাতীয় ইতিহাসের অংশ, একে নতুন-পুরাতন হিসেবে ভাগ করা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ।

বিকল্প প্রস্তাবনা:
রাষ্ট্রীয় দিবসের নাম হওয়া উচিত
১. সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য,
২. রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন,
৩. জাতীয় ঐক্য ও চেতনার বাহক,
৪. ইতিহাসের ধারাবাহিকতার প্রতি সম্মানসূচক,
৫. গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি দায়বদ্ধ।

এই নীতির আলোকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ নামটি প্রশ্নবিদ্ধ।
সুতরাং বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা যেতে পারে

১) ফ্যাসিবাদ-বিরোধী দিবস (Anti-Fascist Day),
২) গণ-পুনর্জাগরণ দিবস/জাতীয় পুনর্গঠন দিবস।
রাষ্ট্রীয় দিবসের নাম হতে হবে এমন যা ইতিহাস, সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি নৈতিক ও সাংবিধানিক সেতুবন্ধন রচনা করে।
রাষ্ট্রের মৌল কাঠামো  যেমন নাম, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র এসব অপরিবর্তনীয়।
নাম বদল মানে হলো জনগণের আত্মপরিচয়ের পুনঃনির্মাণ, যা বিপজ্জনক।
‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা অতি দ্রুত প্রত্যাহার করাই হবে সরকারের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto