Hot

পিআর পদ্ধতিতে ভোট ঐকমত্য না হলে গণভোট ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে ১০ দল

সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন দাবি করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম। গতকাল রাজধানীর সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান। সমাবেশে ১০ রাজনৈতিক দল এবং কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধিও অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে অংশ নেয়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও পৃষ্ঠা ৫ কলাম ১
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করেন। সকাল থেকে শুরু হওয়া দুইপর্বের সমাবেশ শেষ হয় সন্ধ্যায়। এতে আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে অংশ নিতে ভোর থেকেই দলটির নেতাকর্মীরা সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে থাকেন। সকালেই সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান নেতাকর্মীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। 
১৯৭২ সালের সংবিধান জনগণের বিশ্বাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। এই সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে। আজ দরকার রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। জুলাই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র শাসক পরিবর্তনের জন্য ছিল না, এটি ছিল একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আন্দোলন। তিনি বলেন, ২৪’র জুলাইয়ের ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের বিচার না করে নির্বাচন করা চলবে না। গণহত্যা, গুম, লুটপাটের জন্য ফ্যাসিস্ট চক্রের কাউকে ছাড় দেয়া যাবে না। 

নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে তিনি বলেন, যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের তত আসন থাকতে হবে। এটি জনগণের, জেনজি প্রজন্মের এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের যৌক্তিক দাবি। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নিতে হবে। চরমোনাই পীর বলেন, বারবার রক্ত দিয়েছি, কিন্তু সফলতা পাইনি, কারণ ভুল নেতা ও নীতির হাতে দেশ তুলে দিয়েছি। এবার ইসলামপন্থিদের ঐক্যের সময় এসেছে। এক বাক্সে ভোট নিলে ইসলামপন্থিরাই হবে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা নিঃস্বার্থভাবে এই সরকারের পাশে আছি। তবে সরকার যেন সংস্কার ও নিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচ্যুৎ না হয়।

রেজাউল করীম বলেন, দুর্নীতি থেকে মুক্তি ও সুশাসনের জন্য এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থান ঘটেছে। আর সময় নেই রাষ্ট্র সংস্কার এখনই করতে হবে। সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্যই আমরা সংস্কারের কথা বলছি। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া সুষ্ঠু রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কেউ ‘জালেম’ হবে না। দেশের মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। পতিত সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা পাচার করেছে, নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই, অবশ্যই বিচার করতে হবে।

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে দেশের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি আসবে। আমরা অতীতে নেতা নির্বাচনে ভুল করেছি। এবার ইসলামপন্থি দলগুলোর ঐক্য নিয়ে জনগণের মধ্যে বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। শুধু ইসলামপন্থি নয়, দেশপ্রেমিক সকল দলকে নিয়ে আগামী নির্বাচনে একটি শক্তিশালী জোট  হতে পারে। গণভোটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মৌলিক সংস্কারে অনেকে গড়িমসি করছেন, এটা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এই অবস্থায় সংস্কারের প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য না হলে গণভোট আয়োজন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংস্কার, বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্বে আপনারা থাকুন, আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি এবং ইনশাআল্লাহ্‌ থাকবো। কিন্তু আমরা আর পুরনো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বহাল থাকতে দেবো না। রাজনীতির নামে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের প্রতিহত করবো।

ভবিষ্যতের রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা চাই একটি সমৃদ্ধ, ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে। আমাদের তরুণদের বলছি, আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দেবো। নারী আমাদের জনশক্তির অর্ধেক। দেশ গঠনে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নারীকে পণ্য বানাতে দেবো না। আমরা চাই রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা ও একটি দক্ষ প্রশাসন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘মহাসমাবেশ থেকে ফিরে গিয়ে কমিটিগুলোকে আরও সক্রিয় করুন। ঘরে ঘরে যান, ভোটারদের ইসলামের দাওয়াত দিন, ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরুন। ৫ই আগস্টের পর ইসলামের পক্ষে যে গণআন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সেখানে আমরা যদি সোচ্চার না হই, তাহলে এ মাটিতে আগাছা জন্মাবে। যারা নুরুল হক নুরের মতো দেশপ্রেমিক মানুষকে অপমান করেছে, যারা ভোটকেন্দ্র দখল করতে চায়, তাদের উৎখাত করতে হবে।

সমাবেশে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের আহ্বানে ভেদাভেদ ভুলে সকল ইসলামিক দল এক হয়েছে। তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকের সমাবেশ থেকে বার্তা হচ্ছে পিআর পদ্ধতি ছাড়া জনগণ নির্বাচন মেনে নিবে না। নির্বাচনের পূর্বে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। ছাত্র-জনতার রক্ত আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না। আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতার প্রমাণ নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এ সময় নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার করতে হবে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নতুন কোনো ফ্যাসিবাদকে আমরা জন্ম দিতে চাই না। জুলাই সনদ ৫ই আগস্টের পূর্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় ঐকবদ্ধতার মধ্যদিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে প্রতিহত করবো। 

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ এ মঞ্চে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সমাবেশ শুধু একটা দলের দেখেছেন সামনে আরও অনেক দল করবে। সংস্কার কমিশনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, দু’-একটি দলের উপর ভিত্তি করে সংস্কারের প্রস্তাবে পরিবর্তন আনা যাবে না। দু’-একটা দলকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দুঃসাহস দেখাবেন না। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। জীবদ্দশায় কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। জনগণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন এ সরকারের অধীনে দিতে হবে।   

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, হাজার হাজার মানুষ রক্ত দিয়েছে পূর্বের সিস্টেমের পরিবর্তনের জন্য। নতুন বাংলাদেশ কোনো টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের জায়গা হবে না। উচ্চ কক্ষের নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে প্রায় সকল দল একমত হয়েছে। কিন্তু একটি দলের আপত্তির কারণে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পেশি শক্তির বলে জোর-জবরদস্তি করে নির্বাচনে জয়ের ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। কোনো শক্তি বাংলাদেশের সংস্কারে আন্দোলন দাবায় রাখতে পারবে না। এ সময় তিনি পিলখানা ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানান।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ইসলামী আন্দোলন আমাদের অন্যতম সহযোদ্ধা, কে কি বলেছে তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। জুলাইয়ের শহীদদের রক্তত্যাগ ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে চললে কোনো বিদেশি এজেন্টদের চক্রান্ত আমাদের কিছু করতে পারবে না।

২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে আগামী বাংলাদেশে আর কোনো ফ্যাসিস্ট দাঁড়াতে পারবে না। মাদ্রাসার ছাত্রদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন,  এই অভ্যুত্থানে মাদ্রাসার ছাত্র ভাইদেরকে পাঞ্জাবি, টুপি দেখে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে। আগামীর বাংলাদেশে তারা যেন টার্গেট কিলিং-এর শিকার না হয় সে জন্য সবাইকে ঐকবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে।  জনগণের প্রতিনিধিত্বে পিআরের বিকল্প নেই। তাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে সবাইকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। 

ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চাই, বিএনপি কেন মানছে না। বিএনপি তো বলেছেন আমরা জাতীয় সরকার গঠন করবো। আর জাতীয় সরকার গঠনের জন্য ভালো সিস্টেম হলো পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। জাতীয় সরকার হবে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক সরকার। সকল দলের অংশগ্রহণে একমাত্র পিআর সিস্টেমে সরকার গঠন করতে পারে। 

এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমাদের নানা রকমের মাজহাব আছে, নানা তরিকা ও নানা সংস্কৃতি আছে। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার একত্মবাদের ক্ষেত্রে এবং ইসলামে দাওয়াতের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সংবিধান পরিবর্তন করে নির্বাচন দিতে  হবে। নির্বাচন চান পিআর মানেন না, নির্বাচন চান স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হোক মানেন না কেন? আমরা এই টালবাহানা চলতে দিতে চাই না। বাংলাদেশের মানুষ সংস্কারের মধ্যদিয়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে একটা নির্বাচন চায়। যতবার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে প্রত্যেক গণঅভ্যুত্থানের পরে পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং সংবিধান পরিবর্তন ও সংস্কার করেই নির্বাচন দিতে হবে।

এদিকে দিনব্যাপী এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অভিমুখে দলের নেতাকর্মী সমর্থকদের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো উদ্যান প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত যানবাহনের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় সরকারি ছুটির দিন হলেও পথচারীদের চরম দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়েছে। সমাবেশে হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনা কেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও বক্তব্য রাখেন। 

সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে দলের মুখপাত্র এবং যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান ১৬ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।  

সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মুজিবুর রহমান, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মূসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দীন, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউসুফ সাদিক হক্কানী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto