Trending

নজরদারির নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত বিগ ব্রাদারের উত্থান

প্রযুক্তি, রাজনীতি আর নিপীড়নের যুগলবন্দি : এনকেভিডি থেকে গুয়ান্তানামো, আর এখন ট্রাম্প-মাস্কের আমেরিকা

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এক গণ-টেকনো-পর্যবেক্ষণ রাষ্ট্রে রূপান্তর করছেন—যার নেপথ্যে রয়েছে এআই, বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং, সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণ এবং গুপ্তচর ড্রোন।

এক সময় ছিল, যখন মানুষ মনে করতো নজরদারি মানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম যুগের গোয়েন্দা পুলিশ এনকেভিডি, কালো কোট পরা লোকেরা রাতের অন্ধকারে দরজায় কড়া নাড়ে আর কাউকে ধরে নিয়ে যায়। স্ট্যালিনের সোভিয়েত রাষ্ট্র তার বিরোধীদের সাইবেরিয়ায় বরফে ঢাকা নির্বাসন শিবিরে পাঠাতো — কোনো বিচার, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।

কালের পরিক্রমায় সেই লোহিত রাশিয়া ভেঙে পড়েছে, কিন্তু নজরদারির সূত্রগুলো এখন আরও পরিণত, আরও নিখুঁত, আরও প্রযুক্তিনির্ভর। সেই ক্ষমতা এখন এক লিবারেল গণতন্ত্রের দাবিদার রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর হাতে।

এই নতুন আমলে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার ‘তারকা উপদেষ্টা’ ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রকে এক গণ-টেকনো-পর্যবেক্ষণ রাষ্ট্রে রূপান্তর করছেন—যার নেপথ্যে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বায়োমেট্রিক স্ক্যানিং, সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণ এবং গুপ্তচর ড্রোন।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল এক রক্তাক্ত পরীক্ষাগার। বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পায়ন, আবার তার ফাঁকে গণহত্যা, বন্দিশিবির আর নরকে পাঠানোর নিপুণ প্রশাসনিক কাঠামো। এই সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল এক নীরব অথচ সর্বব্যাপী শক্তি-এনকেভিডি।

এনকেভিডি হলো Narodny Komissariat Vnutrennikh Del– অর্থাৎ “স্বরাষ্ট্র বিষয়ক গণকমিসারিয়াত। ১৯৩৪ সালে এটি পুরনো গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থা জিইউপিইউ-এর স্থলাভিষিক্ত হয়। তবে এনকেভিডি ছিল তার চেয়েও ভয়ংকর। এর হাতে ছিল বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, নির্যাতন, শাস্তি ও নির্বাসনের আইনগত ক্ষমতা।

স্তালিনের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য এনকেভিডি ছিল এক নিষ্ঠুর হাতিয়ার। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত যা পরিচিত গ্রেট পার্জ হিসেবে। সেই গণহত্যার শিকার হয় লাখ লাখ মানুষ। সামরিক অফিসার, লেখক, শিক্ষক, কৃষক, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ছিলেন এই শুদ্ধি অভিযানের লক্ষ্য।

একটি ছোট্ট প্রতিবাদ, একটি পুরনো চিঠি বা এক প্রতিবেশীর অভিযোগই যথেষ্ট ছিল এনকেভিডির হাতে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাতের অন্ধকারে কড়া নাড়তো ‘কালো গাড়ি’, ভোরবেলা জানা যেত—সে মানুষটিকে সাইবেরিয়ার গুলাগে পাঠানো হয়েছে বা হয়তো ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে গুলি করে মারা হয়েছে।

এনকেভিডির পরিচালনায় গড়ে তোলা হয়েছিল শ্রম শিবিরগুলোর বিশাল নেটওয়ার্ক—গুলাগ। Glavnoe Upravlenie Lagerei, অর্থাৎ প্রধান শিবির প্রশাসন—যেখানে লাখ লাখ বন্দীকে পাঠানো হতো। সাইবেরিয়ার জমাটবাঁধা তুষার, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা আর ১৬ ঘণ্টার শ্রম—এই ছিল বন্দীদের জীবন। খাদ্য স্বল্পতা, রোগ আর নির্যাতনে প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যু ঘটতো, আর এনকেভিডির কাগজে লেখা থাকতো, “বন্দী মৃত্যুবরণ করেছে হৃদরোগে”।

এনকেভিডি শুধু এক নিপীড়ক সংস্থা নয়, বরং ছিল এক আধুনিক নজরদারি রাষ্ট্রের প্রোটোটাইপ। সন্দেহভাজন নাগরিকদের গোপনে অনুসরণ, চিঠিপত্র পর্যবেক্ষণ, আত্মীয়-স্বজনকে টার্গেট করা—এগুলো সবই আজকের টেকনো-সারভেইলেন্স স্টেট ধারণার পূর্বসূরি। আজকের যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মত রাষ্ট্রগুলোর ‘এআই নির্ভর নজরদারি নেটওয়ার্ক’ যদিও প্রযুক্তিগতভাবে অনেক আধুনিক, কিন্তু সেই একই রাষ্ট্রীয় মনোবৃত্তির ছাপ সেখানে বিদ্যমান, নিজের নাগরিককে সন্দেহ করা, তথ্য জোগাড় করা, নিয়ন্ত্রণ করা। স্বৈররানি হাসিনার দেড় দশকের বেশি শাসনামল বাংলাদেশের মানুষও এ ধরনের তিক্ত, রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে।

এনকেভিডি ছিল এক আতঙ্কের নাম। তাদের এক ‘সামান্য’ ছায়ায় পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারত। সে সময়ে সোভিয়েত সমাজে কথিত ছিল, যদি তোমার দরজায় মাঝরাতে কড়া নাড়ে কেউ, বুঝে নাও এনকেভিডি এসে গেছে। মানুষ মুখ বন্ধ করে রাখতো, প্রতিবেশীকে বিশ্বাস করতো না। কারণ, এনকেভিডি শুধু শরীর নয়, মন ভেঙে দিতো। একজন বন্দীকে ভেঙে ফেলতে হলে তার স্ত্রী-সন্তানদের সামনে এনে নির্যাতন করতো। কিংবা বন্দীকেই বাধ্য করতো তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে।

১৯৫৪ সালে এনকেভিডির জায়গায় কেজিবি আসে, কিন্তু সেই নজরদারি ও নিপীড়নের ঐতিহ্য বজায় থাকে। এনকেভিডি ইতিহাসের সেই অন্ধকার অধ্যায়, যা প্রমাণ করে—রাষ্ট্র যখন মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়, তখন সে আর রাষ্ট্র নয়, এক নিছক নিপীড়নযন্ত্র।

আজকের তথাকথিত উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” যদি নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করতে চায়, তার মুঠোফোন, কথা, মুখাবয়ব বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে চায়—তবে তা এনকেভিডির আধুনিক সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের এনকেভিডি এক সময় দেশের সব কিছুর উপর নজর রাখতো, কে কী পড়ছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে কথা বলছে। আজকের আমেরিকায় সেই দায়িত্ব নিচ্ছে ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস), যার হাতে এখন সেলফোন ট্র্যাকিং সফটওয়্যার, সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষক টুলস আর ফেস রিকগনিশন ড্রোন।

যে ভাবে এনকেভিডি রাজনৈতিক ‘অপরাধী’দের সাইবেরিয়ায় পাঠাতো, সেই পন্থায় এখন মার্কিন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) ব্যবহার করছে ইমিগ্রেশনওএস নামের একটি নতুন ডিপোর্টেশন প্ল্যাটফর্ম। যার মাধ্যমে অভিবাসীদের শনাক্ত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ট্রাম্প প্রশাসন চায়, গুয়ান্তানামো বে যেন এখন শুধু বিদেশি সন্ত্রাসবাদীদের জন্য নয়, বরং ডিজিটাল ‘অপরাধী’দের জন্যও প্রস্তুত থাকে।

আপনি ফেসবুকে গাজার গণহত্যার প্রতিবাদ করছেন? হয়তো টুইটারে কোনো খ্রিস্টান নেতার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করেছেন? তাহলে আপনি এখন ট্রাম্পীয় আমেরিকার ডিজিটাল হুমকি।

বেবেল এক্স ও সোশ্যালনেট নামের টুল দিয়ে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, এমনকি ডেটিং অ্যাপ-এর তথ্য বিশ্লেষণ করছে মার্কিন সরকার। আর এগুলোর পেছনে রয়েছেন ইলন মাস্ক, যিনি ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজিই পরিচালনা করছেন—এই বিভাগ এখন সরকারি সব তথ্য এক জায়গায় করে মারাত্মক প্রোফাইল তৈরি করছে মার্কিন নাগরিকদের।

এই ব্যবস্থায় কে কার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, কী কেনাকাটা করে, কোথায় খায়, কখন বিয়ে করে—সবকিছু জানা যাচ্ছে ডেটা ব্রোকারদের মাধ্যমে, যারা কিনে নেয় আপনার অনলাইন আচরণের প্রতিটি ছাপ।

যখন সোভিয়েত এনকেভিডি কাউকে ধরে নিয়ে যেতো, সে ফিরতো না।

আজকের আমেরিকায়, যখন মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে এক নারীকে শনাক্ত করা হয় যে তিনি গর্ভপাত করাতে অন্য রাজ্যে গেছেন, তখন তাকেও গোপনে নজরদারির জালে ফেলা হয়।

যে প্রযুক্তি দিয়ে তালেবান বা আল-কায়েদার সদস্যদের খুঁজে বের করা হতো, সেই একই প্রযুক্তি এখন অভিবাসী শ্রমিক, কলেজ ছাত্র, এমনকি স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্টদের পিছু নিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা শুধুই একটি প্রযুক্তির ব্যবহার নয়—এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো বদলে দেওয়ার কৌশল।

১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে মানুষ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু শেষমেশ এনকেভিডির লোহিত হাত তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল।

আজকের আমেরিকায়ও, বিগ টেক আর সরকারি এআই প্রকল্প হাত মিলিয়ে তৈরি করছে এমন এক নজরদারি যন্ত্র, যার কাছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—সব আজকাল বিলাসিতা মাত্র।

তিমনিত গেব্রু, গুগলের প্রাক্তন গবেষক, যিনি এআই-এর পক্ষপাত ও সংখ্যালঘুদের উপর এর প্রভাব নিয়ে লিখেছিলেন, তিনি বলেন—“ট্রাম্প যা করছে, তা খুব দ্রুত ঘটছে। ‘বিগ টেক’ এখন যে কাজ আগে গোপনে করতো, এখন তা করছে প্রকাশ্যে, গর্বভরে, আর গণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে।

যারা ভাবছেন, এটা শুধু অভিবাসীদের জন্য—তারা ভুল করছেন।

এক্সেস নাও-এর গবেষক মাইকেল ডি ডোরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন—“এই প্রযুক্তি একবার চালু হয়ে গেলে, তা যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। এমনকি ট্রাম্প সমর্থকরাও একদিন এই ব্যবস্থার শিকার হতে পারেন।”

ইউরোপের অবস্থা কি ভালো? না। মোটেও না। ফ্রন্টেক্স, ইউরোপোল ইতোমধ্যে ফেস রিকগনিশন, এআই টুলস কিনছে—আমেরিকার পথেই হাঁটছে তারা।

এনকেভিডি ফিরেছে, শুধু মুখোশ বদল করে! এনকেভিডি বন্দি করতো বন্দুক হাতে। আজকের টেকনো-এনকেভিডি বন্দি করে অ্যালগরিদম দিয়ে। সাইবেরিয়ার বরফ আজ ক্লাউড সার্ভারের ডেটা সেন্টার। আর পশ্চিমা বা মার্কিন গণতন্ত্র? সেটা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে এক নজরদারিমূলক কর্পোরেট সাম্রাজ্যে, যেখানে প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি নিঃশ্বাস আর প্রতিটি প্রতিবাদ রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের গোপন নোটবুকে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto