সমুদ্রের গভীরে স্বর্ণের ডিম পেলেন বিজ্ঞানীরা

এই ‘হট স্পট’টির বিশাল অংশ স্বর্ণের ডিমে ঢাকা ছিল। ওই অঞ্চলে ২৬ লাখ ‘স্বর্ণের ডিম’ রয়েছে। সেগুলো ফুটতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় নেবে।
সমুদ্রের গভীরে ঘুমিয়ে আছে আগ্নেয়গিরি। সেখানে অদ্ভুত বস্তুর সন্ধান পেলেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। কানাডার সন্নিকটে প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে হদিস মিলেছে লাখ লাখ রহস্যময় ডিমের। সাধারণ ডিমের তুলনায় একেবারে আলাদা, বিজাতীয়। স্বর্ণের রঙের ডিমগুলো থরে থরে সাজানো ছিল আগ্নেয়গিরির পেটের ভেতর।
কানাডার পশ্চিম উপকূলের কাছে পাওয়া লাখ লাখ জীবন্ত ডিমগুলো গবেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ২০২৩ সালে প্রথম এই অদ্ভুত ডিমগুলোর সন্ধান পান গবেষকেরা। কানাডার ফিশারিজঅ্যান্ড ওশন্সের অনুসন্ধানকারী সংস্থার গবেষকদের চোখে পড়ে এই অজানা বস্তুগুলো। সামুদ্রিক পরিবেশ সুরক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে কানাডার এই সরকারি সংস্থাটি।
আলাস্কা উপসাগরের গভীরতা সম্পর্কে জানার জন্য এবং সেখানে লুকিয়ে থাকা রহস্যের সন্ধান করতে একদল অভিযাত্রী দুঃসাহসিক অভিযান চালান। প্রাথমিকভাবে আগ্নেয়গিরি নিয়ে অনুসন্ধান পর্ব চালাতে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন অভিযাত্রীরা। উপকূল থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ২৪ দিনের এই অভিযানে সমুদ্রের চার মাইল পর্যন্ত গভীরে পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনা ছিল সমুদ্রবিজ্ঞানীদের।
আগ্নেয়গিরিতে পৌঁছোনোর আগে পর্যন্ত গবেষকেরা জানতেন না যে তাদের জন্য বিশাল এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তাদের কেউ জানতেন না পানির নীচে থাকা আগ্নেয়গিরিটি সক্রিয় রয়েছে। এমনকি তা থেকে যে তাপ নির্গত হচ্ছে, তা ছিল কল্পনারও অতীত।
গবেষণাদলের প্রধান গবেষক ডু প্রিজ জানান, এই ‘হট স্পট’টির বিশাল অংশ সোনালি ডিমে ঢাকা ছিল। তারা মনে করছেন, ওই অঞ্চলে ২৬ লাখ ‘স্বর্ণের ডিম’ রয়েছে। সেগুলো ফুটতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় নেবে বলে ধারণা প্রিজের।
একটি রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রের সাহায্যে অতি সাবধানে ডিমের নমুনা তুলে আনেন গবেষকেরা। প্রতিটি ডিমের দৈর্ঘ্য ২০ ইঞ্চি, ব্যাস চার ইঞ্চি। ডিমের অতি সূক্ষ্ম খোলা ভাঙতেই বেরিয়ে আসে রেশমের মতো টিস্যু। নমুনাগুলো সাবধানে টিউবে সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণাগারে আরো খুঁটিয়ে বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণের পর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ডিম্বাকার বস্তুটি কোনো ত্বকের টিস্যুর মতো পদার্থ দিয়ে তৈরি। অন্তত বাইরে থেকে দেখে তা-ই অনুমান গবেষকদলের। আরো বিস্তারিত গবেষণার ফলাফল শিগগিরই কানাডিয়ান সরকারের একটি বিজ্ঞান প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রিজ।
ডিম্বাকার ওই বস্তুর একটি অংশে একটি মাত্র ফুটো দেখা গেছে। তা থেকেই তাদের ধারণা হয়েছে, এটি অচেনা কোনো সামুদ্রিক প্রাণী হতে পারে, বাইরে থেকে যার শক্ত খোলস দেখা যাচ্ছে।
প্রথমে ডিমগুলোর সাথে চেনা কোনো প্রাণীর শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যের মিল পাননি গবেষকেরা। অনেকেই বলতে শুরু করছিলেন যে নতুন প্রাণী আবিষ্কৃত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। দু’বছর পর গবেষকেরা মনে করছেন, ডিমগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি প্রাণীর হতে পারে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, অভিযাত্রীদের ডুবোযানের আলো প্রতিফলিত হওয়ার কারণে বস্তুটিকে সোনালি রঙের দেখাচ্ছিল। অন্য বিভিন্ন ছবি খুঁটিয়ে দেখে বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত, বস্তুটি আসলে হলদে-বাদামি রঙের। এই ডিমগুলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটের। এই প্রাণীটি সমুদ্রের ৯ হাজার ৫০০ ফুট গভীরে ঠান্ডা জলে বাস করে এবং দৈর্ঘ্যে ছয় ফুটেরও বেশি হতে পারে।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটের ডিমের আকৃতি বিশাল হয়। ভ্রুণগুলো যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় তাই বড় বড় ডিম পাড়ে ক্রেটরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর স্বাভাবিক সময়কাল চার থেকে ১০ বছর। কিন্তু আগ্নেয়গিরির উষ্ণ পরিবেশ সেই সময়কালকে ত্বরান্বিত করে।
আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন ভূ-তাপীয় শক্তি প্রাকৃতিক ইনকিউবেটরের কাজ করে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, আগ্নেয়গিরির তাপ সেই ডিম ফোটার সময়কে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সাহায্য করে। গরম, খনিজ সমৃদ্ধ এই তরল পদার্থ আশপাশের পানিকে উত্তপ্ত রাখে, যা কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর গভীর সমুদ্রে বেঁচে থাকার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি করে।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে বেশির ভাগ বিজ্ঞানী এই লাখ লাখ ডিমের উৎস হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা স্কেটকেই বেছে নিয়েছেন। তবুও রয়ে গেছে প্রশ্ন। ডিমের আকার এবং অস্বাভাবিক সংখ্যা এই সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে যে একাধিক সামুদ্রিক প্রাণীর প্রজাতিও আগ্নেয়গিরির চূড়াকে প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আগ্নেয়গিরির শিখরটি একটি অগভীর, তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত স্থান। গভীর সমুদ্রে এই ঘটনা বিরল বলে মনে করছেন তারা।
প্রশান্ত মহাসাগরে স্বর্ণের ডিমের রহস্যের সমাধান করতে নানা মহলের বিজ্ঞানী এবং সমুদ্রবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পরিকল্পনা করছে ফিশারিজ অ্যান্ড ওশন্স। শিগগিরই রহস্যের সমাধান হবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।