নাইজেরিয়ান চক্রের ফাঁদে প্রতারিত শতাধিক বাংলাদেশী

‘প্রতারণার ক্ষেত্রে তারা বিদেশী হোয়াটসঅ্যাপ অথবা টেলিগ্রাম ব্যবহার করে অথবা ভুয়া অনলাইন ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুক্তভোগীদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া নম্বর সংযুক্ত করতো।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎকারী একটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দু’ নাইজেরিয়ান নাগরিক ও তাদের সহযোগী একজন বাংলাদেশী নারী রয়েছে।
রোববার (৬ জুলাই) রাত থেকে সোমবার (৭ জুলাই) দিনব্যাপী রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং মিরপুরের পল্লবীতে পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত দু’ নাইজেরিয়ান নাগরিক হলেন ফ্র্যাঙ্ক কোকো (৩৬), এম্যানওয়েল (৩৫) এবং বাংলাদেশী নারী সদস্য মোসা: সুইটি আক্তার (২৭)। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত দু’টি ল্যাপটপ, চারটি আইফোন, তিনটি স্মার্ট মোবাইল ফোন, তিনটি বাটন মোবাইল ফোন, একটি ট্যাব, একটি ওরিকো ব্র্যান্ডের হার্ড ড্রাইভ উদ্ধার করা হয়।
সোমবার রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জাহিদুল করিম বলেন, গ্রেফতারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার সাথে জড়িত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতিকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিদেশী নম্বর ব্যবহার করে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটি চক্র বিভিন্ন দফায় অর্থ আত্মসাৎ করছিল। একইসাথে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেও চক্রটি প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে আসছিল। বিশ্বাস অর্জনের পরই চক্রটি ভুক্তভোগীদের লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ধরনের প্রতারণা বর্তমানে ব্যাপক হারে বেড়েছে এবং চক্রটি তথ্য প্রযুক্তির দিক থেকে যথেষ্ট দক্ষ।’
তিনি বলেন, ‘প্রতারণার ক্ষেত্রে তারা বিদেশী হোয়াটসঅ্যাপ অথবা টেলিগ্রাম ব্যবহার করে অথবা ভুয়া অনলাইন ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুক্তভোগীদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া নম্বর সংযুক্ত করতো।’
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিদেশী সোশ্যাল মিডিয়া নম্বর অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছি যে, এ চক্রে কিছু নাইজেরিয়ান নাগরিক জড়িত যারা বাংলাদেশী মেয়েদের মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করে আড়ালে থেকে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাজেন্ট নম্বরে সরাসরি ক্যাশ ইন/ক্যাশ আউট করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে। তাদের নিয়োজিত নারীদের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করার সাথে সাথেই হাতিয়ে নেয় লাখের বেশি টাকা।’
র্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, ‘বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে তারা মূলত একজন বিত্তবান বিদেশী নাগরিকের বেশ ধরে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ, বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে ডলারের প্যাকেজ পাঠানো অথবা কাস্টম ক্লিয়ারেন্সে বিদেশ থেকে পাঠানো দামী পণ্য নিষ্পত্তি করার জন্য নির্ধারিত চার্জ দাবি করে প্রতারণা করে। এক্ষেত্রে তারা ফটোশপ করা বিভিন্ন ধরনের ছাড়পত্র ও সার্টিফিকেট বানিয়ে গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করে প্রথম ধাপে সামান্য অর্থ হাতিয়ে নেয়। পরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স অথবা বিভিন্ন ডকুমেন্টেশনের জন্য বড় অঙ্কের টাকা দাবি করা হয় যা অধিকাংশ গ্রাহক প্রলুব্ধ হয়ে টাকা দেয়।’
র্যাব জানায়, গ্রেফতার নাইজেরিয়ান নাগরিক কোকো ও এম্যানুওয়েল প্রায় দু’ বছর এই প্রতারণার সাথে জড়িত। তাদের সহযোগী সুইটি আক্তার তিন মাস ধরে তাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন। কোকো দু’ বছর আগে র্যাব-১০ এর হাতে গ্রেফতার হয়। চলমান অভিযানে তাদের থেকে দু’টি নগদ ও বিকাশ অ্যাকাউন্ট এ প্রায় ১৮ লাখ টাকার স্টেটমেন্ট পাওয়া যায়, যেখানে এখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঠানো মেসেজের বরাতে টাকা জমা হচ্ছে।
র্যাব আরো জানায়, তারা এর পাশাপাশি আরো মোবাইল ব্যাংকিং সিম এবং অ্যাকাউন্ট ব্যাবহার করে যা উদ্ধার করার প্রক্রিয়া চলমান। গ্রেফতার নারী সদস্য মূলত বাংলাদেশের লোকাল কোর্ডিনেটর/মিডিয়ার বেশ ধরে বিভন্ন বাংলাদেশীদের নম্বরে যোগাযোগ করে এবং তাদের প্রলুব্ধ করে অর্থ আত্মসাৎ করে। এক্ষেত্রে তার পাশাপাশি অন্য কিছু বাঙালিরাও এর সাথে সম্পৃক্ত। মিডিয়া হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা প্রতারণায় প্রাপ্ত ১০-১৫ শতাংশ টাকার শেয়ার পায়।
র্যাব-১-এর অধিনায়ক জাহিদুল করিম বলেন, ‘গ্রেফতার বিদেশী দু’ নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ দীর্ঘদিন আগেই শেষ হয়েছে বলে তারা জানায় এবং একজনের পাসপোর্ট আগেই জব্দ করা হয়েছে। বিদেশী নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ না থাকলে বাড়ি ভাড়া বা সাবলেট না দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।’
বিদেশী নাগরিকদের ভিসা না থাকা ও পাসপোর্ট জব্দ থাকার পরেও কেন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে র্যাব-১-এর এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আগের মামলা গুলোর নথিপত্র দেখে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাব।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রে অবশ্যই পাসপোর্ট এবং ভিসার মেয়াদ সঠিক আছে কিনা যাচাই করে নিতে হবে।’
কত জনের সাথে প্রতারণা করেছে-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত শতাধিক নাগরিকের কাছ থেকে কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। কেউ ৫০ হাজার দিয়েছে কেউ এক লাখ দিয়েছে।’
চক্রটির সাথে আরও কেউ জড়িত রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশী-বিদেশী আরো কিছু ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। তাদেরকেও গ্রেফতার করা হবে।’