জুলাইয়ের ৩৬ দিন : আন্দোলন দমাতে ছোড়া হয় ৩০ লাখের বেশি গুলি: আল জাজিরার অনুসন্ধান

আবু সাইদের হত্যাকাণ্ড হুমকি ও ঘুষের মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে শেখ হাসিনার সরকার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট (আই-ইউনিট) সম্প্রতি জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেশ কিছু গোপন ফোনালাপ প্রকাশ করেছে। ওই ফোনালাপে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমন করতে সরাসরি প্রাণঘাতী হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
‘হাসিনা- জুলাইয়ের ৩৬ দিন’ শিরোনামের আল জাজিরার অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারিতে আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের কথোপকথন, সিদ্ধান্ত ও দমননীতির তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, টানা তিন সপ্তাহের সেই আন্দোলনে কমপক্ষে এক হাজার ৫০০ জন নিহত এবং ২৫ হাজারের বেশি আহত হন। সে সময় বিক্ষোভ দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী ৩০ লাখের বেশি গুলি ছোড়ে।
১৮ জুলাইয়ের একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনাকে ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার নির্দেশ তো আগেই দেয়া হয়ে গেছে। আমি পুরোপুরি ওপেন অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। এখন ওরা মারবে, যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে। আমি তো এতদিন থামিয়ে রেখেছিলাম। আমি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছিলাম।’
তার নিজের গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড করা আরেকটি কলে তাকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টার ব্যবহার করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে শোনা গেছে। তিনি বলেন, ‘যেখানে তারা কোনো জটলা দেখছে, সেটা উপর থেকে- এখন তো উপর থেকেই হচ্ছে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, এই অভিযানের কোড নাম ছিল ‘অপারেশন ক্লিন ডাউন’। অভিযানে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন অনেক বিক্ষোভকারী একসাথে জড়ো হতো, তখন তারা তাদের হত্যা করার জন্য সেখানে হেলিকপ্টার পাঠানো হতো।
আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আল জাজিরার অনুসন্ধানে বলা হয়, আবু সাইদের হত্যাকাণ্ড হুমকি ও ঘুষের মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে শেখ হাসিনার সরকার। আবু সাইদের পরিবারকে হুমকি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে টেলিভিশনে সাক্ষাৎ করানো হয়।
শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ফোনে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহে তৎপর ছিলেন। আরেকটি অডিও রেকর্ডিংয়ে তাকে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে কি-না তা বলতে শোনা যায়। এরপর তিনি জানতে চান, ‘রংপুর মেডিক্যাল কলেজের কেন আমাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে সময় লাগছে। লুকোচুরি কে খেলছে- রংপুর মেডিক্যাল?’
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘আবু সাইদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমাকে পাঁচবার লিখতে হয়েছে। আমি প্রতিবার রিপোর্ট লিখি, যখন জমা দিতে যাই পুলিশের মন মতো হয় না। আমার মনে হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকেই আবু সাইদের রিপোর্টকে টেম্পারিং করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।’
সে সময় বহু আন্দোলনকারী হেলিকপ্টার থেকে চালানো গুলিতে নিহত ও আহত হন বলে তিনি নিশ্চিত করেন।
আল জাজিরা আরো জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যেন সহিংসতার রক্তাক্ত চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে না পৌঁছায়। এর প্রমাণ মিলেছে ফাঁস হওয়া গোপন সরকারি নথিতে।
তবে আল জাজিরাকে দেয়া এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শেখ হাসিনা কখনোই ‘লিথাল ওয়েপন’ শব্দটি ব্যবহার করেননি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী হামলার নির্দেশ দেননি। তিনি জানান, শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, বিক্ষোভকারীদের সৃষ্ট ক্ষতির কারণেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছিল।