চীনের সুপার-ড্যাম পরিবেশগত ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের কারণ

ভারতীয় মিডিয়া দ্য হিলের এক প্রতিবেদনে চীনের সুপার-ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পকে পরিবেশগত ও ভূকৌশলগত ‘টাইম বোমা’ হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে, এটি কেবল আরেকটি বাঁধ নয়, বিশেষ করে বর্তমান যুগে, যখন পানির উপর নিয়ন্ত্রণ বিংশ শতাব্দীতে তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীন পদ্ধতিগতভাবে ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করছে।
মিডিয়াটির অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি এবং বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই মাসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সর্ববৃহৎ বাঁধ নির্মাণের কথা স্বীকার করেছে। যদিও স্যাটেলাইট চিত্র থেকে বোঝা যায় যে, ২০২১ সালে মেগা প্রকল্পটির অনুমোদনের পর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর অবস্থিত এই সুপার-ড্যামটি ভূমিকম্প এড়াতে সক্ষম এবং তিব্বত-ভারতীয় সীমান্তের কাছে পরিবেশগতভাবে ভঙ্গুর অঞ্চলে অবস্থিত। একবার সম্পন্ন হলে বিশাল কাঠামোটি ইয়াংজি নদীর থ্রি গর্জেস বাঁধের ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। হিমালয়ের চূড়া থেকে বিশ্বের গভীরতম গিরিখাতে ব্রহ্মপুত্রের তীব্র অবতরণকে কাজে লাগিয়ে প্রায় তিন গুণ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাইরেও এই প্রকল্পটি একটি আসন্ন ভূ-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সঙ্কটের ইঙ্গিত দেয়। এটি ভাটির কোটি মানুষের জলবিদ্যুৎ ভারসাম্যকে ব্যাহত করবে, একটি হিমালয়ের দুর্বল বাস্তুতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করবে এবং বেইজিংকে তার কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের ওপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলবে। চীনের থ্রি জর্জেস বাঁধ, যা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম, একসময় এর নির্মাণ কারিগরির জন্য সমাদৃত হলেও এই বাঁধটি পরিবেশগতভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এটি নদীর তীর এবং ব-দ্বীপ ক্ষয় করছে, পানির গুণমান হ্রাস করছে, ঘন ঘন ভূমিধসের কারণ হচ্ছে এবং পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতি করছে। নতুন সুপার-ড্যামের স্থানটি একটি ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইনে অবস্থিত, যা বিপর্যয়ের একটি কারণ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, বৃহৎ বাঁধের জলাধারগুলো ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে, যা রিসার্ভার ট্রিগারড সিসমিক সিটি নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে এই ধরনের মেগাস্ট্রাকচার দ্বারা সৃষ্ট টেকটোনিক চাপ ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের ঝরনা, হিমবাহ গলন, উঁচু জলাভূমি এবং উপনদীর পানি দ্বারা পুষ্ট। এই উৎসগুলোর বেশির ভাগই চীন-অধিকৃত তিব্বতে অবস্থিত, যেখানে নদীটি ইয়ারলুং জাংবো নামে পরিচিত। বিপরীতে, ভারত সারা বছর ধরে নদীর পানির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সামান্য অবদান রাখে, যদিও এটি বর্ষাকালীন জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশ এবং আসাম রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়।
কিন্তু একটি নদীর প্রবাহ কেবল পানির উপর নির্ভর করে না- এটি পলিও বহন করে, যা সমগ্র অঞ্চলের পরিবেশগত জীবনধারা হিসেবে কাজ করে। চীন-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে নদীটি বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বেইজিং আন্তঃসীমান্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ শুষ্ক মৌসুমে। এটি ইচ্ছামতো পানি আটকে রাখতে বা ছেড়ে দিতে পারে, পলি আটকে রাখতে পারে এবং ভবিষ্যতের বিরোধে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশে পৌঁছানোর আগেই পলিমাটি ভর্তি পানি ধরে রাখার মাধ্যমে বাঁধটি নিম্নাচলের প্লাবনভূমিগুলোকে পর্যাপ্ত পলির অভাবের মধ্যে ফেলবে যা কৃষিজমিকে পুষ্ট করতে ব্যর্থ হবে এবং মৎস্যজীবীদের সমস্যায় ফেলবে। সমুদ্রের পানির উত্থানের কারণে এরইমধ্যে হুমকির মুখে থাকা বাংলাদেশের ব-দ্বীপ আরো সঙ্কুচিত হবে, লবণাক্ত পানি প্রবেশ করবে এবং ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি দেখা দেবে।
ব্রহ্মপুত্রের প্রাকৃতিক বন্যা চক্রের সম্ভাব্য ব্যাঘাতও একইভাবে উদ্বেগজনক। বর্ষাকালে মৌসুমি বন্যা গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত কার্য সম্পাদন করে। এই ছন্দ ব্যাহত হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের কৃষি অর্থনীতি এবং নদীর উপর নির্ভরশীল লাখ লাখ বাংলাদেশীর জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অধিকন্তু পলি আটকে রেখে এবং প্রবাহ পরিবর্তন করে ১৬৮ বিলিয়ন ডলারের এই বাঁধ নদীর তলদেশ ক্ষয় করতে পারে, আবাসস্থলের অবনতি ঘটাতে পারে এবং উপকূলীয় ক্ষতি ত্বরান্বিত করতে পারে। চীন জলবিদ্যুৎও উৎপন্ন করবে- যা প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত ফলাফলকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
তিব্বত মালভূমিতে উৎপন্ন নদীগুলোতে চীনের বাঁধ নির্মাণের উন্মাদনা দীর্ঘ দিন ধরে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড থেকে নেপাল পর্যন্ত ভাটির দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই প্রকল্পটি আরো উদ্বেগজনক কারণ এর বিশালতা এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানের জন্য। ভারতের জন্য এই বাঁধটি কেবল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়েও আরো বেশি কিছু। এটি একটি সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের কারণ হতে পারে। যদি উত্তেজনা আবার বৃদ্ধি পায়- যেমনটি ২০২০ সালে ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনের গোপন অনুপ্রবেশের পরে হয়েছিল- তাহলে বেইজিং চাপ প্রয়োগের জন্য নদীর উজানের নিয়ন্ত্রণকে কাজে লাগাতে পারে। ভারতের বিস্তৃত অরুনাচল প্রদেশ রাজ্যের ওপর চীনের দাবির কারণে এটি অশুভ ইঙ্গিতপূর্ণ যাকে তারা ‘দক্ষিণ তিব্বত’ বলে অভিহিত করে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বাঁধের উপযোগিতার এক মাত্র দিক। এর বৃহত্তর মূল্য কৌশলগত আধিপত্যের মধ্যে নিহিত। বাঁধের গুরুতর প্রভাব সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখনো নীরব। ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সীমিত। কঠোর বাস্তবতা হলো যে চীনের উজানের দৃঢ়তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভারতের কাছে খুব কম কূটনৈতিক বা আইনি হাতিয়ার রয়েছে। তা সত্ত্বেও, ভারত এশিয়ার ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে তিব্বতের মর্যাদার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পক্ষে এবং আন্তঃসীমান্ত নদী উন্নয়নের জন্য বাধ্যতামূলক নিয়ম প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিতে পারে।
চীনের একাধিপত্যবাদ এই অঞ্চলে প্রতিবেশীদের অবিশ্বাস এবং কৌশলগত বৈষম্যকে আরো গভীর করে। বেইজিং তার প্রতিবেশীদের সাথে কোনো বাধ্যতামূলক পানিবণ্টন চুক্তির পক্ষ নয়। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভূতাত্ত্বিকভাবে অস্থিতিশীল অঞ্চলে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই বিশাল প্রকল্পের জন্য বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশগত বা ভূমিকম্পের সম্ভাবনাও মূল্যায়ন করা হয়নি। ব্রহ্মপুত্রের সুপার-ড্যাম আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। এটি চীনের ‘পানি আধিপত্যবাদ’ -কৌশলের প্রতীক।